বাংলাদেশে দারিদ্র চিন্তা:
ভাবনার দারিদ্র যেখানে প্রকট
আবুল বারকাত
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(ই-মেইল: যফৎপ.নফ@মসধরষ.পড়স)
বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর)
আয়োজিত
শাহ এ এম এস কিবরিয়া
স্মারক বক্তৃতা
ঢাকা: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন
১৪ মাঘ ১৪১৮/২৭ জানুয়ারি ২০১২
প্রাক্কথন
শাহ এ এম এস কিবরিয়ার জনকল্যাণকামী অর্থনীতি দর্শন
“দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয়, কর্মসংস্থানের সুযোগে সৃষ্টি হয় এবং প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়Ñ যখন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ বৃদ্ধি একটি গতিশীল অর্থনীতির চালিকা শক্তি। বিনিয়োগ শুধু শিল্পে বা কৃষিতে নয়; শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করা হলে তার ফল খুবই ইতিবাচক হয়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি যখন আয়ত্তে থাকে, তখন উচ্চ প্রবৃদ্ধি জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। বস্তুত এই দুই সূচকের সুষম সমন্বয় দেশের অর্থনীতির সার্বিক স্বাস্থ্য ও ভারসাম্যের পরিচায়ক।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতি: সামনে কি সুদিন আসছে? প্রবন্ধ সংগ্রহ: ২০০৭, পৃ: ২৭২
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছিলেন ক্ষমতার আসনে একজন জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যতিক্রমি প্রগতিশীল মানুষ। এ দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কেন যেনো হয় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন অথবা জনমানুষের কল্যাণে জন-সমৃদ্ধির (ঢ়বড়ঢ়ষব'ং বিষষ-নবরহম অর্থে) লক্ষে কর্মকাণ্ড পরিচালনে ব্যর্থ হন। অথচ তারা ক্ষমতার আসন গ্রহণ করেন প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ঐ বিধান মেনে নিয়ে যেখানে সুষ্পষ্ট লেখা আছে “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ” [অনুচ্ছেদ ৭ (১)]। শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছিলেন ব্যতিক্রমি মানুষ এ জন্যেই যে তিনি সংবিধানের এ বিধান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এবং সে বিশ্বাস থেকেই দেশের অর্থনীতি পরিচালন করেছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃতই অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন উষ্ণ হৃদয় দেশপ্রেমিক মানুষ। মানবকল্যাণমুখী অর্থনীতির ভিত্তি প্রসারণে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার জ্ঞান-ভিত্তিক নেতৃত্ব ছিল সত্যিকার অর্থেই অতুলনীয়। আমার মতে তার দেশভাবনার বড় জায়গা জুড়ে ছিলো মুক্ত বাজার অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করেই বৈষম্য হ্রাসকারী উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের দর্শন। আর সে কারণেই তার অর্থনীতি ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বৃহত্তর জনগোষ্ঠি যার অধিকাংশই দরিদ্র-বঞ্চিত। জনকল্যাণকামী এ ভাবনা বাস্তবায়নে তিনি প্রচলিত উন্নয়ন কাঠামোর মধ্যেই বৈষম্য হ্রাস, দারিদ্র নিরসন, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, সামাজিক উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি প্রশস্ত করা, ভূমি সংস্কার, বৈষম্য হ্রাস উদ্দিষ্ট রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতিÑ এসব বিষয়ে বিশেষ জোর দিতেন। এসবই ছিল প্রাথমিক স্তরের পূঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যে জনকল্যাণ নিশ্চিত করার প্রায় অসম্ভব এক প্রয়াসÑ যা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর ছিলেন শাহ কিবরিয়া। অর্থনীতি শাস্ত্রের মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রতীক। আর প্রধানত এ কারণেই আমার মনে হয়েছে দারিদ্র-বঞ্চনা সংশ্লিষ্ট ভাবনাই হওয়া উচিত আজকের স্মারক বক্তৃতার কেন্দ্রিয় বিষয়।
দারিদ্র চিন্তা ও ভাবনার দারিদ্র: কেনো এ প্রসঙ্গ?
পনেরো কোটি মানুষের এদেশে ‘দারিদ্র’ যে সবচে রূঢ় বাস্তবতা এবং সত্যিকার অর্থে উদ্বেগের বিষয়, তাতে কেউই সম্ভবত দ্বিমত পোষণ করবেন না। অতীতেও এ নিয়ে দ্বিমত ছিল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতেও এ উদ্বেগের নিরসন হবে না। এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে সুস্থ-সবল-চেতনাসমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক ভেদহীন মানুষ সৃষ্টিই ছিল আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। কিন্তু তা অর্জিত হয়নি। আর অর্জিত হয়নি দেখেই এখন “রূপকল্প ২০২১” বাস্তবায়ন জন-আকাঙ্খায় রূপান্তরিত হয়েছে যার মর্মবস্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর র্পূতি নাগাদ ২০২১ সালের বাংলাদেশ হবে “অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, উদার-গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র”; ২০২১ সালের বাংলাদেশ হবে স্বল্প-বৈষম্যপূর্ণ মধ্য আয়ের একটি দেশ; ২০২১ সালের বাংলাদেশ হবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ জ্ঞানভিত্তিক একটি দেশ। তাই মানব-কল্যাণমুখী রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতি গঠনপ্রক্রিয়ায় ‘দারিদ্র’ বিষয়টিকে আমরা বারবার-প্রতিনিয়ত উত্থাপন করতে চাই।
অর্থনীতি শাস্ত্রের মানুষ হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন – উভয় কারণেই দারিদ্র বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন জরুরী বলে মনে করি। আমি মনে করি দারিদ্রের বহুমাত্রিকতা, বিমোচনের শ্লথ গতি এবং সেই সঙ্গে আমাদের দারিদ্র বিষয়ে অন্যদের (অতি)-আগ্রহ ইত্যাদি কারণে বিষয়টির খোলামেলা, যুক্তিনির্ভর, জ্ঞানসমৃদ্ধ মূল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়ন এ বিষয়ে সঠিক-সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। ‘দারিদ্র’ বিষয়টি পুনঃউত্থাপন করতে চাই এজন্যও যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে “ভাবনার দারিদ্র” প্রকট; মূল ধারার গবেষকদের দারিদ্র চিন্তায় চিন্তার দারিদ্র প্রকট।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: ‘দারিদ্র্য’ রাজনৈতিক স্লোগান মাত্র
“বিশ্বের প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়, এতে ব্যতিক্রম নেই বলা যায়। দেশের শাসন পদ্ধতি গণতান্ত্রিক হোক বা না হোক, সব শাসকই দারিদ্র্য বিমোচনের স্লোগান ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসেন।....তবে নির্বাচনের সময় দরিদ্র্যের প্রতি দরদের আধিক্য দেখা যায়। কিন্তু দারিদ্র্য দূর করার জন্য অঙ্গীকার প্রায়ই বাস্তবায়িত হয় না।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, কেমন আছেন দেশের গরিব মানুষ? কেমন চলছে অর্থনীতি? নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ: ২০০৭, পৃ: ১১৭
“বাংলাদেশে দারিদ্র” বিষয়ে এ দেশের মানুষের মনে প্রশ্নের শেষ নেই; প্রশ্ন শেষ হবার কোনও শর্তও সৃষ্টি হয়নি। তাই দারিদ্র সংক্রান্ত উদ্বেগ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। হতে পারে উদ্বেগ উদ্বেগই থেকে যাবে। সম্ভবত অনেক প্রশ্নের উত্তর এ মুহূর্তে আমরা পাবো না। কিছু প্রশ্নে মতানৈক্য থাকবে, সেটাও স্বাভাবিক। নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হবে, তা আশার কথা। এসব বিবেচনা থেকে কয়েকটি বিষয় উত্থাপন জরুরী বলে মনে করি। আর সেই সাথে দারিদ্র-বঞ্চনা উচ্ছেদ ও হ্রাসের লক্ষে কিছু সমাধান-ভাবনাও উপস্থাপন করতে চাই।
দারিদ্র আসলে কি? দারিদ্রের মর্মার্থ না জানলে দারিদ্র দূরীকরণ বা হ্রাসকরণ বললে কি বুঝবো?
আমার মনে হয় দারিদ্রের সংজ্ঞায়নে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আত্মপ্রবঞ্চনা করছি। আমরা দরিদ্র মানুষের দৃষ্টিতে দারিদ্র দেখি না। এমনকি আমাদের মতো অদরিদ্রদের দারিদ্র পরিমাপের প্রয়াসও দরিদ্র মানুষের দৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয়। কারণ, মাথাপিছু নির্দিষ্ট পরিমাণের আয়, মাথাপিছু ২,১২২ কিলোক্যালরির নীচে খাদ্য ভোগ, সাক্ষরতা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রকৃত নিরক্ষরতা হ্রাস না পাওয়া, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ সৃষ্টি করা (দরিদ্ররা সে সুযোগ গ্রহণ করুক বা না করুক) – দারিদ্র সংজ্ঞায়ন ও পরিমাপণে এসব স্থূলতা অতিক্রম করতে আমরা অক্ষম হয়েছি। আর এসব কারণেই ‘দরিদ্র জন্মসূত্রেই দরিদ্র হতে বাধ্য’ – এ ধারণা আমাদের গবেষকদের বোধের দারিদ্রই নির্দেশ করে। সে কারণেই দারিদ্র দূরীকরণ বা হ্রাসের প্রেসকিপশনগুলোও অনুরূপ স্থূল।
“দারিদ্র” আমার মতে নেহায়েত এক অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ নয় যা ‘আয়’ এবং/অথবা ‘খাদ্য পরিভোগ’ দিয়ে মাপা হয়। যেমন বলা হয় Ñ যদি কেউ দৈনিক ৬৭ টাকার কম আয় অথবা ২,১২২ কিলো ক্যালরির কম খাদ্য ভোগ করেন তিনিই দরিদ্র, আর তার অবস্থাটা “দারিদ্র”। দারিদ্র পরিমাপের এ স্থূলতার বিপরীতে আমি মনে করি যা কিছু মানুষের পরিপূর্ণ জীবন প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করে সে সবই দারিদ্রের মানদণ্ড। দারিদ্র হলো সুযোগের অভাব বা সমসুযোগের অভাব। আর বৈষম্য-বঞ্চনা থেকেই এর উৎপত্তি। এ বৈষম্য-বঞ্চনা প্রধানত অর্থনৈতিক হলেও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়।
দারিদ্র বহুমুখী। দারিদ্র হতে পারে আয়ের দারিদ্র, ক্ষুধার দারিদ্র, কর্মহীনতার দারিদ্র, স্বল্প-মজুরীর দারিদ্র, আবাসনের দারিদ্র, শিক্ষার দারিদ্র, স্বাস্থ্যের দারিদ্র, অস্বচ্ছতা-উদ্ভূত দারিদ্র, শিশু দারিদ্র, প্রবীণ মানুষের দারিদ্র, নারী-প্রধান খানার দারিদ্র, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের দারিদ্র, ভাসমান মানুষের দারিদ্র, প্রতিবন্ধী মানুষের দারিদ্র, ‘মঙ্গা’ এলাকার মানুষের দারিদ্র, বহিঃস্থ জনগোষ্ঠির দারিদ্র, বস্তিবাসী ও স্বল্প-আয়ি মানুষের দারিদ্র, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপর্যয়ের দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা-উদ্ভূত দারিদ্র, প্রান্তিকতা উদ্ভূত দারিদ্র (অনানুষ্ঠানিক সেক্টর, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণ-দলিত, পশ্চাৎপদ-পেশা, চর-হাওর-বাওর-এর মানুষ), রাজনৈতিক দারিদ্র (রাষ্ট্রিয় নীতি-নির্দ্ধারণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ না করতে পারার কারণে দারিদ্র), রাষ্ট্র-সরকার পরিচালনাকারীদের প্রতি আস্থাহীনতা-উদ্ভূত দারিদ্র, মানস-কাঠামোর (সরহফ ংবঃ) দারিদ্র ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, একজন দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রে উল্লিখিত দারিদ্রের একাধিক রূপ প্রযোজ্য হতে পারে। আমি মনে করি দারিদ্রকে দেখতে হবে সব ধরনের দারিদ্রের পরস্পর সম্পর্কিত যৌথ রূপ হিসেবে যেখানে প্রতিটি রূপ ভিন্ন ভিন্নভাবে দারিদ্রের নির্দিষ্ট অংশকে প্রতিফলিত করে মাত্র। তবে এমনও হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তে দারিদ্রের কোনো এক বা একাধিক রূপ অন্যসব রূপের তুলনায় অধিক গুরুত্ব বহন করে। সেই সাথে এ কথাটি স্পষ্ট হতে হবে যে দারিদ্র হ’তে পারে তুলনামূলক (ৎবষধঃরাব) অথবা নিরঙ্কুশ (ধনংড়ষঁঃব)। সুতরাং আমার বিশ্বাস ‘দারিদ্র বিমোচন’ বললে আমরা বুঝবো দারিদ্রের কোনো কোনো রূপের তুলনামূলক হ্রাস (ঢ়ড়াবৎঃু ৎবফঁপঃরড়হ)আবার কোন কোনটির নির্মূল বা উচ্ছেদ (ঢ়ড়াবৎঃু বৎধফরপধঃরড়হ)।
আমার সার বক্তব্য এক বাক্যেও শেষ করা যেতে পারে। আর তা হলো: যেহেতু দারিদ্র বিষয়টি শেষ পর্যন্ত শোষণ সৃষ্টিকারী কাঠামো উদ্ভূত (ংঃৎঁপঃঁৎধষ) সেহেতু স্থায়ীভাবে দারিদ্র বিমোচন করতে হলে বর্তমান কাঠামোটি ভেঙ্গে তার জায়গায় নূতন কাঠামো বসাতে হবে; আর যুুক্তিগতভাবেই এ কাজটি পারে দরিদ্র শোষিত মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ। এ বক্তব্যে সাম্যবাদী মতাদর্শের গন্ধ আছে বিধায় অনেকেই বাতিলযোগ্য বিবেচনা করলেও য্ুিক্ত হিসেবে বক্তব্যে ভুল নেই। ভুল-ভ্রান্তি থাকলে তা আছে সময়ের নিরিখে সম্ভাব্যতা বিচারে। সে কারণেই বক্তব্য এক কথায় শেষ করা যাচ্ছে না। বক্তব্য এক কথায় শেষ করা যাবে না এ জন্যেও যে আমরা সবাই মিলে আপাতত ধরেই নিয়েছি যে সম্ভবত: পুঁজিবাদী কাঠামোতেই আমাদের চলতে হবে; ধরেই নিয়েছি যে মাত্রা যাই হোক না কেন মুক্ত বাজার অর্থনীতির আবরণের মধ্যেই দারিদ্র হ্রাস/উচ্ছেদ(?)/বিমোচন হতে পারে; ধরেই নিয়েছি যে আমাদের দেশে বাণিজ্যপুঁজি ও ব্যাপক-বিস্তৃত (বিকাশমান) কালো টাকার পুঁজিকে (যা নিকৃষ্ট পুঁজি; গত ৩৫ বছরে যার পুঞ্জিভূত পরিমাণ হবে আনুমানিক ৭ লাখ কোটি টাকা) যে কোন ভাবে শিল্প পুঁজিতে রূপান্তর করলেই দারিদ্রের অনেক রূপ হাল্কা হয়ে আসবে; ধরেই নিয়েছি যে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিশ্বায়ন-এর সুযোগ(!) গ্রহণ করতে পারলেও দারিদ্রাবস্থা উপশম হবে ইত্যাদি। এসব ধরে নেয়ার পিছনের যুক্তি কতটা যুক্তিসিদ্ধ ও বাস্তবসম্মত এ নিয়ে আজকের বিতর্ক-আলোচনা নয়। সুতরাং ভুল-শুদ্ধের বিচার না করেই ‘ধরে নেয়া’ অনুসিদ্ধান্ত মেনেই আজকের আলোচনা।
আপতনভিত্তিক দারিদ্র বিচারপদ্ধতি খুবই স্থুল
সরকারী ও দাতাগোষ্ঠির দারিদ্র সংক্রান্ত দলিলপত্র প্রায়ই সরলীকৃত দারিদ্রের আপাতন (রহপরফবহপব ড়ভ ঢ়ড়াবৎঃু)-কে সবচে’ বেশি গুরুত্ব দেয়। এই ভিত্তিতেই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে ১৯৮৫/৮৬ সালের ৫৫.৭ শতাংশ থেকে ২০০৪ সালে ৪০.৪ শতাংশে আর ২০১০ সালে ৩১.৫ শতাংশ (যবধফ পড়ঁহঃ ৎধঃরড় নধংবফ ড়হ উঈও সবঃযড়ফ অর্থাৎ খাদ্য ভোগ: প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণ এর হিসেবে মাথা-গণনা পদ্ধতিতে)। অর্থাৎ সরকারী হিসেবে গত ২৫ বছরে দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। অথচ একই সরকারী দলিল বলছে দরিদ্র মানুষের নিরংকুশ সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ এমনকি সরকারী স্থূল হিসেবকে আমলে নিয়েও স্পষ্ট বলা যায় যে, তুলনামূলক দারিদ্র (শতাংশ হিসেবে) হ্রাস পেলেও মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পেতে থাকবে। তিরিশ বছর আগে ৭০ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করতো। তখন মোট দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি। এখন সরকারী হিসেবে প্রায় ৩২ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করলেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। এ দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশী। সুতরাং দারিদ্রের আপতন-ভিত্তিক স্থূল হিসেবপত্তরও নির্দেশ করে যে, দেশে দারিদ্র হ্রাস পায় নি। এ কথা আরো সত্য হবে যদি দারিদ্র পরিমাপে ইতোপূর্বে উল্লেখিত দারিদ্রের বিভিন্ন রূপ আমলে নেয়া হয়।
দরিদ্র কে? বাংলাদেশে আসলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কত?
আমার ধারণা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের “রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি” ও “মৌলিক অধিকার” সংক্রান্ত ৮ থেকে ৪৩ পর্যন্ত অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগণের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিতরাই দরিদ্র। এ হিসেবে বাংলাদেশের শতকরা ৮৩ ভাগ মানুষই দরিদ্র। সাংবিধানিক অধিকার (১৯৭২) থেকে বঞ্চিতরাই দরিদ্র। বহুমাত্রিক মানব বঞ্চনা দূরীকরণে আমাদের সংবিধান যে সব অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্র“তি দেয় তা হলো নিম্নরূপ:
১. প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ (অনুচ্ছেদ ৭.১)
২. অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ১৫.ক)
৩. কর্মের অধিকার; যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কাজের নিশ্চয়তার অধিকার
(অনুচ্ছেদ ১৫.খ)
৪. সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৫.খ)
৫. সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা;... মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ (অনুচ্ছেদ ১৯/১,২)
৬. একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা;.... আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর (অনুচ্ছেদ ১৭ ক,খ)
৭. মেহনতী মানুষকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তি (অনুচ্ছেদ ১৪)
৮. জীবনমানের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কৃষি বিপ্লব (অনুচ্ছেদ ১৬)
৯. জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ (অনুচ্ছেদ ১০)
১০. মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধÑ নিশ্চিতকরণ (অনুচ্ছেদ ১১)
১১. ....জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না (অনুচ্ছেদ ৩২)
১২. .... কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না (অনুচ্ছেদ ২৮.১)
১৩. আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান (অনুচ্ছেদ ২৭) ।
আমি মনে করি দরিদ্র মানুষেরা বঞ্চিত। আমি মনে করি বঞ্চিতরাই দরিদ্র Ñ এ বঞ্চনা হতে পারে সাংবিধানিক এবং ন্যায়-অধিকার কেন্দ্রিক। আগেই বলেছি খাদ্য-পরিভোগ কেন্দ্রিক দারিদ্র পরিমাপ খুবই স্থুল। শারীরিকভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য পরিভোগ দারিদ্র পরিমাপের ক্ষেত্রে এক ধরনের “গরু-ছাগল” পদ্ধতি। বিপরীতে আমি মনে করি দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত; বস্তুগতÑ আত্মিকÑ আবেগী সম্পদ থেকে বঞ্চিত; যে বঞ্চনা তাদের বেঁচে থাকাÑবিকাশ-সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে; যে বঞ্চনা তাদেরকে করে অধিকারহীন; যা তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি/ক্ষমতাকে বিকশিত হতে দেয় নাÑ ফলে তারা সমাজের “সম-সদস্য” হতে পারেন না এবং তারা পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হন না। আর বস্তুগত, আত্মিক ও আবেগী সম্পদ বলতে আমি যা বুঝি তার নির্দেশকসমূহ হলো নিম্নরূপ (এ সবের পরিমাপ যতই জটিল অথবা দুরুহ হোক না কেনো):
বস্তুগত (সধঃবৎরধষ) সম্পদ = আয়, খাদ্য, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় অভিগম্যতা; খাস জমি-জলা-বনভূমিতে অধিকার;
আত্মিক (ংঢ়রৎরঃঁধষ) সম্পদ = উদ্যোগ, জীবনবোধের পরিপূর্ণতা, আকাঙ্খা, পারস্পরিক সম্পর্ক, আদর্শ মানুষের মডেল;
আবেগী (বসড়ঃরড়হধষ) সম্পদ= ভালোবাসা-সহমর্মিতা, আস্থা-বিশ্বাস, মর্যাদা, গ্রহণযোগ্যতাবোধ, অন্তর্ভুক্তি, ছিটকে না পড়ার বোধ।
উল্লেখ করা জরুরি যে বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক শ্রেণী বিভাজন সংক্রান্ত সংখ্যাতাত্ত্বিক তেমন কোনো গবেষণা চোখে পড়ে না। এ বিবেচনা থেকে মানুষের প্রকৃত আয়, ভূমি মালিকানা এবং কালো-টাকার মালিকানা একীভূত করে জনসংখ্যার শ্রেণী বিভাজনের চেষ্টা করেছি। আমার হিসেবে ১৫ কোটি মানুষের এ দেশে ৯ কোটি ৮৯ লাখ মানুষই (অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ) গরীব মানুষ (দেখুন: সারণি ১ এবং ধনী-দরিদ্র শ্রেণী পিরামিড-ছক ১)। প্রকৃত অর্থে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হবে আরো বেশী। কারণ বাজার অর্থনীতিতে যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় এবং সেই সাথে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় না এবং প্রকৃত আয় হ্রাস পায় তখন নিম্ন-মধ্যবিত্তরাও আসলে দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। এ বিবেচনায় আমার হিসেবে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে ১২ কোটি ৪৩ লাখ মানুষ (অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ)-ই দরিদ্র। অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের প্রকৃত সংখ্যাটি সরকারী হিসেবের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩২ শতাংশ নয়Ñ হবে ৮৩ শতাংশ। এই ৮৩ শতাংশ মানুষই নিরন্তর বঞ্চিত। বঞ্চনা হিসেবে দারিদ্র এক চক্রাকারে বিবর্তিত হচ্ছেÑ যে চক্র চূর্ণ করা কঠিন, যে চক্র কাঠামোগত (ছক ২)। আর সেই সাথে সময়ের নিরিখে আমাদের দেশে দারিদ্র-বঞ্চনা এক ধরনের পাইপ যে পাইপে দরিদ্র হিসেবে ঢুকবার পথ বেশী আর বেরুনোর পথ কম (দেখুন ছক ৩)। দারিদ্র-বঞ্চনার পাইপটি এমন যে একবার ঢুকলে বেরুনো কঠিন; আবার একবার বেরুলে বাইরে থাকাটাও কঠিন (অর্থাৎ আবার ঢুকার সম্ভাবনা অনেক)।
সারণি ১: বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামোয় দরিদ্র মানুষ, ২০১০
(মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ধরে)
(কোটি মানুষ)
গ্রাম/শহর গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধনী মোট
নিম্ন মধ্য উচ্চ মোট
গ্রাম ৮.০৯ ১.৮২ ০.৯২ ০.৩৪ ৩.০৮ ০.২৩ ১১.৪০
শহর ১.৮০ ০.৭২ ০.৫৪ ০.৩৬ ১.৬২ ০.১৮ ৩.৬০
মোট ৯.৮৯ ২.৫৪ ১.৪৬ ০.৭০ ৪.৭০ ০.৪১ ১৫.০
তথ্য উৎস: প্রবন্ধকার কর্তৃক হিসেবকৃত।
ছক ১: বাংলাদেশে ‘ধনী-দরিদ্র’ শ্রেণী পিরামিড
(২০১০-এ মোট জনসংখ্যা = ১৫ কোটি)
ছক ২: বঞ্চনার চক্র হিসেবে দারিদ্র
ছক ৩: দারিদ্র পাইপ: সময়ভিত্তিক ঢুকা-বেরোনো
সংবিধানকে দরিদ্র পরিমাপণের ভিত্তি হিসেবে ধরলে আমাদের “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক যে জনগণ” (অনুচ্ছেদ ৭.১), তাদের ৮৩ ভাগ দরিদ্র (কয়েকটি নির্দেশক-এর জন্য দেখুন- ছক ৪)। কারণ ১৫ কোটি মানুষের এ দেশে:
ক্স খাদ্য গ্রহণের নিরিখে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি (যা সংবিধানের ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী)।
ক্স প্রায় ৯ কোটি মানুষ এখনও কার্যত নিরক্ষর এবং প্রকৃত শিক্ষা-সুযোগ বঞ্চিত (যা সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ, বিশেষত ১৭গ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী )।
ক্স প্রায় ১০ কোটি মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্য-সেবার সুযোগ বঞ্চিত। আর ৭.৫ কোটি মানুষ সুপেয় পানির অভাবে মরণব্যাধি আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত-ঝুঁকির মধ্যে আছেন (যা সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী)।
ক্স প্রতিবছর যে ৯ লাখ মানুষ এদেশে মৃত্যুবরণ করেন তার অর্ধেকই পাঁচ বা আরও কম বয়সের শিশু। আরও লজ্জাজনক কথা, ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ দারিদ্র-উদ্ভূত। নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় মাথাপিছু ব্যয় মাত্র ১৩ টাকা, ডায়ারিয়ার ১৭ টাকা, হামের ১২ টাকা এবং যক্ষ্মার ৯০০ টাকা। উল্লেখ্য, যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান চতুর্থ শীর্ষে (সংবিধানের ১৫ ও ১৮.১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অবস্থা এমন হ্বার কথা নয়)।
ক্স সাক্ষর-নিরক্ষর মিলে প্রায় ৩ কোটি মানুষ (যাদের অধিকাংশই যুবক) এখনও বেকার (সংবিধানের ১৫খ ও ২০ অনুচ্ছেদ কর্মের অধিকার নিশ্চিত করে)।
ক্স প্রায় ১০ কোটি মানুষ এখনও বিদ্যুৎ সুবিধা বঞ্চিত (অথচ সংবিধানের ১৬ ধারা এ সুবিধা নিশ্চিত করে)।
ক্স সীমিত আয়ের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ প্রকৃত অর্থেই দুর্দশাগ্রস্ত এবং দুর্দশা ক্রমবর্দ্ধমান। এর অন্যতম কারণ দ্রব্যমূল্যের (খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভুত) উর্দ্ধগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জিত হয়েছে কিন্তু দরিদ্র মানুষের খাদ্য-পরিভোগ বৃদ্ধি পায়নি। অন্যদিকে বন্টন-অসমতা বৃদ্ধি পেয়েছে (এসবই সংবিধানের ১৩, ১৫ ও ১৯ অনুচ্ছেদ-এর সঙ্গে সাযুজ্যহীন)।
ক্স দেশের অধিকাংশ নারী, শিশু ও প্রবীণ নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত (যা সংবিধানের ১০, ১১, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২৮ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী )।
ক্স বিরাট এক জনগোষ্ঠি নিশ্চিতভাবেই উত্তরোত্তর অধিক হারে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছেন (যা সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সকল ধারার পরিপন্থী)।
ক্স ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও আদিবাসী মানুষের বঞ্চনা চিরস্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। শত্র“/অর্পিত সম্পত্তি আইনের মারপ্যাচে ইতোমধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫০ লাখ মানুষের ২০ লাখ একর ভূ-সম্পত্তি জবরদখল করা হয়েছে। এই জবরদখলকারীরা আমাদের জনসংখ্যার মাত্র ০.৪ শতাংশ (ক্ষমতাবান/ক্ষমতাধর গোষ্ঠিভুক্ত)। আর ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার আদিবাসীরা কি অর্থনীতি, কি শিক্ষা, কি স্বাস্থ্য – সব দিক থেকেই প্রান্তস্থ (এসব কিছুই সংবিধানের ২৭, ২৮, ও ৪১ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী )।
ছক ৪: বাংলাদেশে সাংবিধানিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা, ২০১০
(২০১০-এর মোট ১৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে)
সংবিধান দারিদ্রদূরীকরণে যা নিশ্চিত করার কথা বলছে আর বাস্তব-প্রবণতা যা দেখছি, তা থেকে আমার হিসেব মতে মৌলিক চাহিদা পদ্ধতিতে জাতীয় ক্ষেত্রে দারিদ্র বিমোচনে সময় লাগবে ২০০-৩০০ বছর। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। দারিদ্র নিরসন কর্মকাণ্ডে হয় মৌলিক পরিবর্তন নয়তো সংবিধানের ৮ থেকে ৪৩ পর্যন্ত অনুচ্ছেদের আমূল সংশোধন জরুরী (সে ক্ষেত্রে সংবিধানের অন্যান্য ১০৬-টি অনুচ্ছেদেও বিভিন্ন মাত্রায় সংশোধন করতে হবে)। আমার মতে এক্ষেত্রে মধ্যপথের অবকাশ নেই (যদিও আমরা অনেকেই মধ্যপথকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি)। তাহলে দারিদ্র দূরীকরণে যে অবস্থায় আমরা উপনীত হয়েছি, তা বিশ্লেষণ করে এ কথা বলবো কি’না যে, এ বিষয়ে সংবিধান কার্যকরী নয়?
দারিদ্র উচ্ছেদ (বৎধফরপধঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়াবৎঃু), না’কি দারিদ্র হ্রাস (ৎবফঁপঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়াবৎঃু), না’কি দারিদ্র উচ্ছেদ ও হ্রাস উভয়ই?
বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. নিকোলাস স্টার্ন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির লোকবক্তৃতায় বলেছিলেন, “আমার টেবিলে দারিদ্র উচ্ছেদ (ধষষবারধঃরড়হ অর্থে) শিরোনামে কোনও কিছু এলে আমি সেটা ধিংঃব ঢ়ধঢ়বৎ নধংশবঃ -এ ছুড়ে ফেলে দিই”। অর্থাৎ তার মতে দারিদ্র উচ্ছেদ সম্ভব নয়। বক্তব্যটি আমার কাছে অর্থনীতিবিদদের দারিদ্র বিষয়ক দর্শন-চিন্তারই দারিদ্র বলে মনে হয়। দারিদ্র উচ্ছেদ ও দারিদ্র হ্রাস – ধারণাগত দিক থেকে উভয়ই সঠিক। আসলে দারিদ্রের মাত্রা দু'টো – নিরঙ্কুশ দারিদ্র (ধনংড়ষঁঃব ঢ়ড়াবৎঃু) আর আপেক্ষিক বা তুলনামূলক দারিদ্র (ৎবষধঃরাব ঢ়ড়াবৎঃু)। আমি মনে করি, মাথাপিছু ২,১২২ কিলোক্যালরির নীচে ভোগ যদি নিরঙ্কুশ দারিদ্রের একটা মাপিকাঠি হয়, সেক্ষেত্রে এ মুহূর্তেই বাংলাদেশ থেকে নিরঙ্কুশ দারিদ্র উচ্ছেদ (হ্রাস নয়) সম্ভব। কারণ আমরা এখন যে পরিমাণ খাদ্য শস্য (ধান, গম, ডাল, ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংশ ইত্যাদি) উৎপাদন করি সেটাকে মোট কিলোক্যালরিতে রূপান্তর করে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হবে মাথাপিছু প্রায় তিন হাজার কিলোক্যালরি। সহজ এই পাটিগণিত বাস্তবে কাজ না করার প্রধান কারণ হল বণ্টন-বৈষম্য। আর সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ বৈষম্য রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিপন্থী। কারণ, বলা হচ্ছে “বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ”। আসলে মূলনীতি শীর্ষক সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা, ১৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণের বিধানসহ কৃষি সংস্কার (ধমৎধৎরধহ ৎবভড়ৎস) ও অন্যান্য জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড (যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি) ছাড়া বণ্টন বৈষম্য রোধের প্রকৃত কোনো উপায় নেই।
নিরঙ্কুশ দারিদ্রের বিপরীতে আপেক্ষিক দারিদ্র উচ্ছেদ বা নির্মূল সম্ভব নয়, হ্রাস সম্ভব। কারণ বিষয়টি তুলনামূলক। এক শ্রেণীতে পাঠরত দু’জনের পরীক্ষার ফল (অথবা জ্ঞান-মাত্রা) ভিন্ন হয় বিভিন্ন কারণে। আবার দু’জনের ফল ভিন্ন হতে বাধ্যÑ এ কথাও অসত্য হতে পারে। দু’জনের প্রথমজন যদি জন্মসূত্রে স্বল্প ওজনের (ষড়ি নরৎঃয বিরমযঃ) এবং সেই সঙ্গে দারিদ্রের কারণে অপুষ্টিবাহিত হয় (বলা হয় জন্ম প্রক্রিয়ার দু’বছরের মধ্যে মস্তিষ্ক কোষের মূল বিকাশ ঘটে থাকে) আর দ্বিতীয়জন যদি ঠিক উল্টো বৈশিষ্ট্যের হয়, তাহলে দু’জনের পরীক্ষার ফল ভিন্ন হবে। আর দু’জনেই অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বাহক হলে (প্রথমজনকে দ্বিতীয়জনের বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত করলে) কি তুলনামূলক ফল ভিন্ন হবে? আমাদের দারিদ্র গবেষকেরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান বলে আমার জানা নেই। তবে আমার বিশ্বাস, অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে পরীক্ষার ফল (অথবা জ্ঞান-মাত্রা) বিষয়ক দারিদ্র হ্রাস নয়, উচ্ছেদই সম্ভব। সুতরাং, সামাজিক বৈষম্য-অবৈষম্যের বিচারে নিরঙ্কুশ দারিদ্র আপেক্ষিক আর আপেক্ষিক (বা তুলনামূলক) দারিদ্র নিরঙ্কুশ। নিরঙ্কুশ ও আপেক্ষিক দারিদ্রের মর্মার্থ অনুধাবনে বিষয়টি আমাদের দারিদ্রাবস্থা বিশ্লেষণ ও দারিদ্র উচ্ছেদ (নির্মূল) এবং/অথবা দারিদ্র হ্রাসের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
দারিদ্র ও উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কিত বিষয়
দারিদ্র ও মানব (মানবিক) উন্নয়ন যে পরস্পর সম্পর্কিত এ বিষয়েও আমাদের চিন্তা কাঠামোতে যথেষ্ট ভ্রান্তি আছে বলে মনে হয়। সরকার ও দাতাগোষ্ঠি প্রায়শই আমাদের বুঝিয়ে থাকেন যে, উন্নয়ন হলে দারিদ্র স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কমে যাবে। আমি মনে করি উল্টো – দারিদ্র উচ্ছেদ হলে উন্নয়ন হবে অথবা দারিদ্র উচ্ছেদ টেকসই উন্নয়নের প্রধান পূর্ব শর্ত। আসলে উন্নয়ন বলতে সরকার ও দাতাগোষ্ঠি যা বুঝিয়ে থাকেন সে অর্থে তা হবে না। তারা উন্নয়ন বলতে মোট উৎপাদনের বৃদ্ধি এবং বৃদ্ধির হার অথবা মাথাপিছু জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি” মহৌষধ নয়
উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনই যে দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় নয়Ñ এ ভুল ভেঙ্গে গেছে। “বেশ কয়েকটি দেশে দেখা গেলো, প্রবৃদ্ধি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে দারিদ্র্যও তেমনি বেড়েছে। অর্থাৎ অল্পসংখ্যক ব্যক্তি বা পরিবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির ও গড় সম্পদ বৃদ্ধির ফল ভোগ করছে; কিন্তু দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এই সমৃদ্ধির অংশীদার হতে পারছে না। কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, দরিদ্র্যের সংখ্যাও বাড়ছে।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, কেমন আছেন দেশের গরিব মানুষ? কেমন চলছে অর্থনীতি? নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ: ২০০৭, পৃ: ১১৭
বুঝিয়ে থাকেন। আমি অন্তত ১০০টি দেশের নাম উল্লেখ করতে পারি যে সব দেশে এসব মাপকাঠিতে উন্নয়ন হলেও সেই সঙ্গে দারিদ্র হ্রাস পায়নি, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য ও দারিদ্রের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং দারিদ্র বিমোচন উদ্দিষ্ট ‘উন্নয়ন’-এর নতুন সংজ্ঞা প্রয়োজন। যে সংজ্ঞা বৈষম্য-হ্রাসকারী উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কথা বলবে। যেখানে উন্নয়ন হবে এমন একটি প্রক্রিয়া যা মানুষের চয়নের স্বাধীনতা (ভৎববফড়স ড়ভ পযড়রপব) নিশ্চিত করে, বিস্তৃত করে। এ অর্থে উন্নয়ন হতে হবে স্বাধীনতা মধ্যস্থতাকারী প্রক্রিয়া (ভৎববফড়স সবফরধঃবফ ঢ়ৎড়পবংং) যেখানে জনগণের জন্য পাঁচ ধরনের চয়ন-স্বাধীনতা নিশ্চিত হতে হবে: অর্থনৈতিক সুযোগ (বপড়হড়সরপ ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু), সামাজিক সুবিধাদি (ংড়পরধষ ভধপরষরঃরবং), রাজনৈতিক স্বাধীনতা (ঢ়ড়ষরঃরপধষ ভৎববফড়স), স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা (মঁধৎধহঃবব ড়ভ ঃৎধহংঢ়ধৎবহপু) ও সুরক্ষার বা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা (ঢ়ৎড়ঃবপঃরাব ংবপঁৎরঃু)। উন্নয়ন দর্শন কৌশল যদি এসব স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় শুধুমাত্র তখনই উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্র বিমোচিত হবে অথবা দারিদ্র বিমোচন টেকসই উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হিসেবে কাজ করবে। মানবিক উন্নয়নের এ দর্শনটি হতে হবে দেশের মাটি-উত্থিত উন্নয়ন দর্শন (যড়সব মৎড়হি ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু) যে দর্শনের মূল ভিত্তি-বিষয়সমূহ হবেÑ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিনির্মাণে সবার সম-সুযোগের নিশ্চয়তা; বহিস্থদের অন্তর্ভুক্তিকরণ (বঞ্চিত, নিঃস্ব, দুস্থ, দুর্দশাগ্রস্ত, দুঃখী মানুষ); মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগের নিশ্চয়তা; মানুষ নিজের জন্য যে জীবন মূল্যবান মনে করেন সে লক্ষ্যে সুযোগের সম্প্রসারণ; অ-স্বাধীনতার সব উৎসমুখ বন্ধ করা; সাংবিধানিক ও ন্যায়-অধিকার-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন; মানুষের অসীম সক্ষমতা বৃদ্ধির সব পথ সম্প্রসারণ; বঞ্চনার-চক্র ভেঙ্গে ফেলা; এবং মানুষের জন্য সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করা। মানবিক উন্নয়নের এ দর্শনে দারিদ্র বিমোচন হবে উন্নয়নের লক্ষ্য, উপলক্ষ নয় (যেটা প্রচলিত চিন্তায় ঠিক উল্টো)।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এখন “সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য” (গরষষবহবহহরঁস উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং) নিয়ে ভাবছেন যার প্রথম লক্ষ্য হল “চরম দারিদ্র ও ক্ষুধা নির্মূল করা” (২০১৫ সালের মধ্যে অর্দ্ধেকে নামিয়ে আনা)। জাতিসংঘের গউএ-তে যেহেতু রাষ্ট্র হিসেবে আমরা স্বাক্ষর করেছি সেহেতু আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে শুরু করে দেশের সংশ্লিষ্ট যে কোনো ফোরামে আমরা “দারিদ্র-ক্ষুধা নির্মূল/উচ্ছেদের” কথা জোরেশোরেই বলতে পারি। সেই সাথে অবশ্যই আমাদের বলতে হবে যে জাতিসংঘে যখন আমরা “দারিদ্র নির্মূল”-এ স্বাক্ষর করলাম তখন দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্রে (চজঝচ) অথবা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিলে কেন “দারিদ্র হ্রাসের” কথা বলছি। ‘নির্মূল’ ও ‘ হ্রাস’ তো এক কথা নয়। এ দ্বৈততা কেন? একি নেহায়েত দ্বৈততা না’কি কমিটমেন্ট-এর অভাব, প্রতিশ্র“তি ও সদিচ্ছার অভাব? এ বিষয়ে জোরে কথা বলে কী হবে তা জানি না, তবে যুক্তি থাকলে উচ্চকন্ঠ হতে অসুবিধা কোথায়?
সরকারের দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র অথবা পাঁচসালা পরিকল্পনা নিয়ে আমরা দু’ভাবে ভাবতে পারি: প্রথমত: এ দেশের দরিদ্র মানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যা কিছু দারিদ্র বিমোচনে প্রয়োজন ছিল অথচ “ উন্নয়ন নীতি-কৌশল দলিলে” জায়গা পায়নি তা চিহ্নিত করা এবং উচ্চস্বরে বলা। যেমন দেশে ২ কোটি বিঘার বেশী যে খাস জমি ও জলা আছে তা কিভাবে দরিদ্র মানুষের ন্যায্য হিস্যাতে রূপান্তরিত হবে (?); অথবা দরিদ্র বেকারদের (প্রধানত: যুব দারিদ্র) কি হবে (?); অথবা বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প কল-কারখানা খোলা নিয়ে ভাবনাটা কি?; অথবা গত ৩৫ বছরে বিদেশী ঋণ-অনুদানের প্রায় ২০০,০০০ কোটি টাকার লুটপাট, আর প্রায় ৭০০,০০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকার কি হবে? ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত: দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র অথবা পাঁচসালা পরিকল্পনায় এমন কি আছে যা দিয়ে দরিদ্র মানুষ বুঝবে যে দারিদ্র দূর হচ্ছে (?); বাস্তবায়ন কৌশলগুলো কী এবং তাতে দরিদ্র মানুষ কিভাবে অংশগ্রহণ করবেন? এ ক্ষেত্রে জনকল্যাণমুখী অর্থনীতিবিদদের দায়িত্ব হতে পারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে “নিজস্ব-দেশজ (যড়সব মৎড়হি)” বিস্তারিত দারিদ্র-বৈষম্যহ্রাসমুখী উন্নয়ন দর্শন ও নীতি-কৌশল প্রণয়ন করে সেটা প্রচার করা এবং যুক্তি থাকলে তা গ্রহণে নাগরিক সমাজ ও সরকারকে পরামর্শ দেয়া। আমাদের “নিজস্ব-দেশজ” “দারিদ্র নির্মূল/বিমোচন কৌশল দলিল” প্রণয়ন এ জন্যও দরকার যে সরকারের তথাকথিত “দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র” রচিত হয়েছে বিশ্ব ব্যাংক ও আই এম এফ-এর কনসেশনাল ঋণ পাবার পূর্ব শর্ত হিসেবে যা এ দেশের “মাটি থেকে উত্থিত” (যড়সব মৎড়হি) নয়। এদেশের দরিদ্র মানুষের নিজস্ব “দারিদ্র বিমোচন নীতি-কৌশল দলিল” প্রণয়ন কোন জোর জবরদস্তির বিষয় নয়Ñ এটা দরিদ্র মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার নীতি-কৌশল হিসেবেই ভাবতে হবে।
দারিদ্র বিমোচন লক্ষ্যে ‘উন্নয়ন’-এর রূপরেখা কেমন হবে বিষয়টি সত্যিকার অর্থে এখনও পর্যন্ত আমাদের অজানা। শুধু দারিদ্রের মর্মবস্তুর নিরিখেই নয়, দারিদ্র-বিমোচন লক্ষ্যের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কেমন হতে পারে, এ বিষয়েও আমাদের জ্ঞানের ভিত্তি যথেষ্ট মাত্রায় দুর্বল বলে আমি মনে করি। দারিদ্র বিষয়ক কোন জ্ঞানতত্ত্বের (বঢ়রংঃবসড়ষড়মু) অস্তিত্ব এ দেশে আছে কি’না, সে বিষয়েও আমি সন্দিহান।
দারিদ্রের উৎস—আত্মঘাতি লুণ্ঠন সংস্কৃতি যা বৈষম্য উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে
এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের যুক্তিসংগত তেমন কোনো কারণ নেই যে দারিদ্রের বিস্তৃতি, মাত্রা, গভীরতা ও তীব্রতা এখন যা এবং যে দিকে এগুচ্ছে, প্রবণতার চাকাটি তার উল্টো দিকে আনতে হবে। আর সেটাই হবে আমাদের সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশের সর্বোৎকৃষ্ট মানদণ্ড। স্বাধীনতার পরে বিশেষত: ১৯৭৫ পরবর্তী বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে আমাদের দেশে উত্তরোত্তর অধিক হারে দারিদ্র-বৈষম্যের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন (ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ ধহফ ৎবঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়াবৎঃু ধহফ রহবয়ঁধষরঃু) হয়েছে। দারিদ্রের উৎসÑবৈষম্যের বিকাশ হয়েছে অবারিত। বৈষম্য সৃষ্টির উৎসসমূহে কি অর্থনীতি, কি রাজনীতি, কি শিক্ষা-সংস্কৃতি– সর্বত্র এক আত্মঘাতি লুন্ঠন সংস্কৃতি (পঁষঃঁৎব ড়ভ ঢ়ষঁহফবৎরহম) জেঁকে বসেছে। এই লুন্ঠন সংস্কৃতির চরিত্র-নিয়ামক হ’ল কালো টাকা, জবর দখল (ভূমিদস্যু-জলদস্যু-বনদস্যু), সন্ত্রাস, পেশি-শক্তি, ঘুষ, দুর্নীতি, কুশাসন-অপশাসন, দমন-নিপীড়ন ইত্যাদি। পুঁজিবাদ বিকাশে লুণ্ঠন নিয়ামক ভূমিকা পালন করে কিন্তু এদেশে আত্মঘাতি লুণ্ঠণ প্রক্রিয়া জাতীয় পুঁজি বিকাশে ব্যর্থ হয়েছেÑ তা না হ'লে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজি বন্ধ হবে কেন? কেন বন্ধ হয়েছে মৌলিক ভারী শিল্প? স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭৫ পরবর্তী অর্থনীতির হরিলুটÑ বৈষম্য বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে “দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদে” (পৎরসরহধষরুধঃরড়হ ঃৎধঢ়) পড়েছে এবং তা থেকে দারিদ্র পুনরুৎপাদিত হচ্ছে এ অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া দারিদ্র বিমোচিত হবে না। বিষয়টি নিম্নরূপ:
ক্স অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কার্যকরী চাহিদা (বভভবপঃরাব ফবসধহফ) বৃদ্ধি করছে; আর ক্রমবর্দ্ধমান রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদকে উত্তরোত্তর শক্তিশালী করছে। দুর্বৃত্তায়নের এ প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে নবসংযোজন হয়েছে গণমাধ্যম দখল।
ক্স গত তিরিশ বছরে সরকারীভাবে যে প্রায় ২.৫ লাখ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ-সাহায্য এসেছে, তার ৭৫ ভাগ লুন্ঠণ করেছে অর্থনীতি–রাজনীতির দুর্বৃত্ত গোষ্ঠি। ফলে ক্ষমতাধররা অধিকতর ক্ষমতাবান হয়েছেন আর ক্ষমতাহীন দরিদ্রের অক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্স ক্ষমতাবানেরা এক ধরনের নিকৃষ্ট পুঁজির (ব্রিফকেস পুঁজি বা কমিশন/দালাল পুঁজি) মালিক হয়েছেন। এ পুঁজি অনুৎপাদনশীল। উৎপাদনশীল বিনিয়োগে এর তেমন আগ্রহ নেই।
ক্স ক্ষমতাবানেরা এখন কালো অর্থনীতির একটা বলয় সৃষ্টি করেছেন, যে দুষ্টচক্রে বছরে এখন ৭৫-৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি হয়, যা জাতীয় আয়ের এক-পঞ্চমাংশ। এ বলয়ে যাদের অবস্থান, তারাই আবার ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি (লুন্ঠণ সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে ঋণখেলাপি সংস্কৃতি)। এরাই বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত। এরাই বছরে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ মুদ্রা পাচার (সড়হবু ষধঁহফবৎরহম) করছেন; এরাই অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি করেছেন যেখানে দারিদ্র বিমোচন অসম্ভব। এরাই আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে এবং/অথবা তাকে ব্যবহার করে দারিদ্র বিমোচন কর্মকাণ্ড দুরূহ করছেন।
ক্স অতীতে দেখা গেছে দুর্বৃত্ত-বেষ্টিত সরকার তার বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে যত না মানুষকে গুরুত্ব দিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে লুন্ঠণের খাতকে। যে পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বিনিয়োগ করে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ মুক্ত করা সম্ভব, তার সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে অপ্রয়োজনীয় অনেক খাতে। বাজেট ঘাটতি হবে অথচ অনুৎপাদনশীল ব্যয় উদ্বৃত্ত হবে। এ ধরনের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত আর যাই হোক দারিদ্র বিমোচন উদ্দিষ্ট নয়।
ক্স ক্ষমতাবান দুর্বৃত্তদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে যা উত্তরোত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট দারিদ্র বৃদ্ধি করছে (যার সবগুলি সংবিধানের ১১, ২৬-২৯, ৩১-৩২, ৩৫-৪১, ৪৩-৪৬ অনুচ্ছেদসমূহের পরিপন্থী)। এসবের পুঞ্জীভূত রূপটি এমনÑ
- যেখানে নির্বাচন মানেই বড় মাপের আর্থিক বিনিয়োগ এবং কালোটাকার প্রতিযোগিতা,
- যেখানে সন্ত্রাস-সহিংসতা অনিবার্য ও নৈমিত্তিক বিষয়,
- যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবমাননা সাধারণ নিয়ম,
- যেখানে সরকারী গণমাধ্যম মানেই স্তুতি প্রচারের যন্ত্র,
- যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ বিষয়টি নেহায়েতই টোকেনইজম (স্লোগান),
- যেখানে সুশাসন বিষয়টি অতিমাত্রায় উচ্চারিত কিন্তু প্রকৃতই মূল্যহীন,
- যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেহায়েতই কাগুজে,
- যেখানে মানুষের দুর্দশা-বঞ্চনাকেন্দ্রিক ব্যবসা সবচে লাভজনক।
সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, একটি আত্মঘাতি লুন্ঠণ প্রক্রিয়া অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজকে দুর্বৃত্তায়িত করার মাধ্যমে সকল ধরনের বৈষম্য সৃষ্টির ভিত্তি সুদৃঢ় করেছে যা দারিদ্র সৃষ্টিতে পালন করছে কেন্দ্রিয় ভূমিকা। এহেন অবস্থায় দারিদ্র হ্রাস (উচ্ছেদের কথা আপাতত ভুললেও চলবে) আদৌ সম্ভব কি?
দারিদ্রের নতুন মাত্রা সম্পর্কে এদেশে খুব কমই ভাবা হয়
দারিদ্রের কয়েকটি নতুন রূপ যেমন শিশু-দারিদ্র, যুব-দারিদ্র, প্রবীণ-দারিদ্রÑএসব নিয়ে এদেশে এখনও পর্যন্ত তেমন কার্যকর ভাবনা-চিন্তা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে শিশু দারিদ্রের মাত্রা, গভীরতা ও তীব্রতা সামগ্রিক দারিদ্রের চেয়ে বেশি। যুবকদের বিশাল অংশ বেকার। আর যুব-বেকারত্ব সৃষ্টি করছে বিশাল এক বাহিনী যা ব্যবহার করছেন কালোটাকার মালিক, রাজনীতিবিদ এবং ধর্ম-ভিত্তিক জঙ্গীরা। যুবদারিদ্র উদ্ভূত নিরাশা সৃষ্টি করছে বিভিন্ন ধরনের নবতর পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক অস্থিরতা। যুবদারিদ্র নিয়ে বাণিজ্য এখন অনেকের জন্য বেশ লাভজনক।
দারিদ্রের নতুন মাত্রা সৃষ্টি হয়েছে প্রবীণ জনগোষ্ঠির মধ্যেও। একদিকে আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ও যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া (অধিকহারে একক পরিবার সৃষ্টি) আর অন্যদিকে প্রবীণদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের অনিশ্চয়তার ফলে ক্রমবর্দ্ধমান হারে সৃষ্টি হচ্ছে বয়স্ক-দারিদ্র। আমাদের দারিদ্রাবস্থা নিরূপণে দারিদ্রের এ তিনটি নতুন রূপ (শিশু দারিদ্র, যুবদারিদ্র ও বয়স্ক দারিদ্র)–নিশ্চিতভাবেই উপেক্ষিত। এসব নিয়ে হয়ত বা দু’একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়ত বা আরও প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। আবারও আমরা প্রস্তর যুগে অনুপ্রবেশ করবো কারণ আরও কয়েকটি প্রকল্পের প্রস্তর ফলক উম্মোচিত হবে। কিন্তু শিশু, যুব ও বয়স্ক-দারিদ্র সৃষ্টির উৎসে হাত দেয়া হবে না।
“সংগঠিত মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট” ও দারিদ্র পুনরুৎপাদন
এদেশে সংগঠিত মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট দারিদ্র পুনরুৎপাদনে অনেক বছর ধরেই জোর ভূমিকা রাখছে। প্রকৃত বাজারের তথ্যের ভিত্তিতে (অর্থাৎ যে দামে মানুষ দ্রব্য/পণ্য কেনেনÑ খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভুত উভয়ই) “সংগঠিত মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট” যে পরিমাণ অর্থ লুট করেছে তা সম্পর্কে আমার হিসেবটি নিম্নরূপ: “সংগঠিত মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট”Ñ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কৃত্রিমভাবে (ধৎঃরভরপরধষষু) বাড়িয়ে গত সরকারের প্রায় ৫ বছরে এ দেশের জনগণের কাছ থেকে মোট ২৮৬,১১০ কোটি টাকা লুট করেছে। মোট লুটের মধ্যে ১৯৩,৮১৭ কোটি টাকা (৬৮%) লুট করেছে খাদ্য-খাতে আর বাদ বাকী ৯২,২৯৩ কোটি টাকা (৩২%) লুট করেছে খাদ্য-বহির্ভূত খাতে। মোট লুটের ৭২ ভাগ হয়েছে গ্রামে আর ২৮ ভাগ হয়েছে শহরে। এ লুটের শিকার হয়েছেন ১ কোটি ৮২ লাখ দরিদ্র পরিবার (৯ কোটি ১০ লাখ মানুষ), ৪৮ লাখ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার (২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ), আর ৩০ লাখ মধ্য-মধ্যবিত্ত পরিবার (১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ)।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
মানুষের অসহায়ত্ব বাড়ায়
“মানুষ বড় সহনশীল প্রাণী। উত্তরমেরুর তুষারবন্দী হয়ে যেমন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, তেমনি আফ্রিকার মরুভূমির রুদ্রতাপেও বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। বিশেষত বেতনের উপর নির্ভর করে যারা চলেন। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ....। ....কিন্তু চালের দাম যখন বাড়ে, তখন মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, “কাঁচা মরিচ নিয়ে লংকাকাণ্ড: অর্থনীতির বিপর্যয়”, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ২৭৭
মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট-এর প্রত্যক্ষ শিকার ১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ১৪ কোটি মানুষ (দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত)। ‘মূল্য সন্ত্রাসের’ কারণে দরিদ্র মানুষকে পরিবার চালাতে গিয়ে হয় খাদ্যভোগ কমাতে হয়, অথবা পুষ্টিহীন হতে হয়, অথবা খাদ্য-বহির্ভূত খাতে (বিশেষ করে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও শিক্ষায়) ব্যয় কমাতে হয়, অথবা অতীতের সঞ্চয় ভেঙ্গে ফেলতে হয়, অথবা দুর্দশাগ্রস্ততার কারণে সম্পদ (যাই ছিল) বেচতে হয় (ফরংঃৎবংং ংধষব)Ñ অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দরিদ্র মানুষ নিঃস্ব হয়ে ভিক্ষুকে রূপান্তরিত হন। অনেকটাই অনুরূপ অবস্থা হয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। আর মধ্য-মধ্যবিত্ত পরিবারÑ যাদের অনেকেই শিক্ষিত কিন্তু বেকারÑএর অবস্থা দ্রুত অধোগতির দিকে নেমে যায়। অতএব, ‘মূল্য সন্ত্রাসের’ এ প্রক্রিয়ায় ১৪ কোটি মানুষের (দেশের ৯৩% মানুষ) দারিদ্র-দুর্দশা-অসহায়ত্ব বৃদ্ধি পায়: দরিদ্র হয় দরিদ্রতর; নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের একাংশ দরিদ্র মানুষের দলে যোগ দিতে বাধ্য হন; আর মধ্য-মধ্যবিত্ত মানুষের একাংশ অবশ্যই নিম্ন-মধ্যবিত্তের দলে যেতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় তথাকথিত “ম্যাক্রো ইকনমিক স্ট্যাবিলিটি” স্রেফ বুদ্ধিবৃত্তিক মার-প্যাচ মাত্র। যেখানে ম্যাক্রো-মাইক্রো অমিল-বেমিল (সরংসধঃপয) বিষয়টি সযতেœ এড়িয়ে যাওয়া হয়।
তথ্য ভিত্তিক আমার হিসেব এ দেশে দুর্বৃত্তায়ন-দুর্নীতি-সন্ত্রাসতত্ত্বকে আরো শক্তিশালী করে Ñ এ বিষয়ে কারো দ্বিধা থাকার কথা নয়। আর অন্যদিকে লুটের এসব হিসেবপত্তর এও নির্দেশ করে যে ওরা প্রচুর কালোটাকার মালিক হয়েছে যার একাংশ তারা লুটপাট তন্ত্র জিইয়ে রাখতে ব্যয় করবে। আবার এ কথাও সত্য যে এত লুট যারা করলোÑ মানুষের ন্যায়-অধিকার বাস্তবায়িত হবার প্রক্রিয়ায় তারা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে?
সংগঠিত সিন্ডিকেটের এসব মূল্য সন্ত্রাসীরা বৃহৎ পর্দার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ঘনিষ্ঠ সহচর মাত্র। সংগঠিত সিন্ডিকেটভিত্তিক এসব মূল্য সন্ত্রাসীরা শুধু চালের মূল্য নিয়েই সন্ত্রাস করে না, এ সন্ত্রাস পিয়াজ-রসুন-ডাল-তেল-গুড়োদুধ-বাস ভাড়া-গ্যাস-পানি-বিদ্যুত-বীজ হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্ত বিস্তৃত, যার প্রধান শিকার নিঃসন্দেহে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষ। এ ছাড়াও ভুললে চলবে না যে দেশে ইতোমধ্যে মৌলবাদের অর্থনীতির এক শক্ত ভীত সৃষ্টি হয়েছে এবং সেইসাথে মৌলবাদী জঙ্গীত্ব যে ‘আত্মঘাতি বোমা সংস্কৃতি’ চালু করেছে তা জীবনের নিরাপত্তা হ্রাসসহ মজুতদারী-কালোবাজারী বৃদ্ধির মাধ্যমে জনজীবন অধিকতর দুর্বিষহ করছে। নূতন এ অবস্থাটা মূল্য সন্ত্রাস বৃদ্ধির সহায়ক যা দারিদ্র বাড়ায়। সুতরাং মূল্য সন্ত্রাসের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভিত্তি যতদিন থাকবে ততোদিন দ্রব্যমূল্য বাড়বে এবং দারিদ্র-বৈষম্য বাড়বেÑ এ বিষয়ে সন্দেহের যৌক্তিক কোন কারণ নেই। একদিকে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন-সৃষ্ট মূল্য সন্ত্রাস আর অন্যদিকে মৌলবাদী জঙ্গীত্বের কারণে মূল্য সন্ত্রাস বৃদ্ধিÑ দারিদ্র পুনরুৎপাদনের এসব সমীকরণ গভীর ভাবনার বিষয়।
“দুর্নীতি দারিদ্র বাড়ায়” আর “বাংলাদেশ বিশ্বের সবচে’ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ”Ñ ঠিক কি?
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: “দুর্নীতি” নিয়ে ভাবনা!
“দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি কারণ যারা সরকারে থাকেন, তারাই দুর্নীতি করেন কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এটা সব সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশন: গোড়ায় গলদ, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ৩৫৮
আমরা এখন শুনতে এবং বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে দুর্নীতি দারিদ্র বাড়ায় এবং বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু এসব বলে দারিদ্রের মূল কারণে না গিয়ে দুর্নীতিকে দারিদ্রের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার (অপ)প্রয়াস আছে। আমি মনে করি এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন সরাসরি উত্থাপন জরুরীÑ তা হলো দুর্নীতি কে বা কারা করেন, কোন গোষ্ঠী করেন? দেশে বছরে যে ৭৫-৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি হয় তাতে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠির মানুষের আদৌ কোন ভাগ আছে কি? দরিদ্র মানুষ কি দুর্নীতি করেন? যদি না করেন তাহলে কারা করেন তা উচ্চকন্ঠে জানান দেয়া দরকার। আর এ কথাটি এখন বলা যেতে পারে যে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দুর্নীতিবাজ শ্রেণী-গোষ্ঠীর হাত থেকে কখনো দুর্নীতি করেননি অর্থাৎ শ্রমজীবী-দরিদ্র মানুষের হাতে ছেড়ে দিলেই তো দুর্নীতি উদ্ভূত দারিদ্র সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। উচ্চস্বরে এ কথা বলতে অসুবিধা কোথায়? না’কি এ বক্তব্য কল্পকথা (ইউটোপিয়া)? পাশাপাশি একথাও তো সত্য যে ফাঁকি না দিয়ে কোথায় শিল্পায়ন হয়েছে? আর শিল্পায়ন ছাড়া কর্মসংস্থান কিভাবে হবে? কিভাবে বাড়বে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি? আমার এ যুক্তি দুর্নীতির পক্ষের যুক্তি নয়Ñ এ যুক্তি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে (যা কখনও দরিদ্র-বান্ধব নয়) শিল্পায়নের পক্ষে দুর্নীতি হ্রাস কৌশল বিনির্মাণের যুক্তি।
দারিদ্র বিমোচনে বিশ্বায়নের সম্ভাব্য ভূমিকা কী হতে পারে?
দারিদ্র দূরীকরণে আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ বিশ্বায়ন নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। “দরিদ্রদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে ইচ্ছুক”(!)Ñ এমন অনেক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অনেকেই এখন এসব নিয়ে মুলত দাতাদের পয়সায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে বেশ বিদেশ যাচ্ছেন। দেশের দরিদ্র মানুষদের স্বার্থ উদ্ধারে দেশের ভিতরে কাজের চেয়ে বিদেশমুখীতা ইদানিং বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এসব করে কী লাভ/কার লাভÑ বিষয়টি বেশ দুর্বোধ্য; তবে আমি জানি “বাজার-দরিদ্র বান্ধব নয়”। অবাধ বাজারভিত্তিক বিশ্বায়নের যুগে (যেখানে অসম প্রতিযোগিতা মুখ্য বিষয়, হড়হ-ষবাবষ ঢ়ষধুরহম ভরবষফ) প্রায়শই শুনি যে আমাদের দেশের শ্রমজীবি মানুষকে অবাধে অন্যদেশে শ্রমশক্তি বিক্রির সুযোগ দিলে এ দেশের দারিদ্র দূর হয়ে যাবে। আপাত দৃষ্টিতে যুক্তির কথা বলেই মনে হয়। কিন্তু যখন দেখি প্রত্যন্ত গ্রামের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের তরতাজা একজন যুবক জমি-জমা-সম্পদ-সম্পত্তি বিক্রি করে ২ লাখ টাকা ব্যয় করে ২ বছরের চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে রাত-দিন পরিশ্রম করে ২ বছরে মোট ২ লাখ টাকা আয় করেন তখন দারিদ্র দূর হল কোথায়? আসলে এসব করে যা হলো তাকে এভাবে বলা চলে “আমাদের ঐ যুবকটি মধ্যপ্রাচ্যে ২ লাখ টাকার সমপরিমাণ বিনিয়োগ করলো যার রিটার্ন শূন্য অথবা নেগেটিভ” অর্থাৎ “মধ্যপ্রাচ্যে আমরা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট করলাম যার নেট রিটার্ন পাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য”। এ তো সম্পদ হাত ছাড়া হবার এক নূতন পদ্ধতি মাত্র (হবঃ ফৎধরহ ড়ভ ৎবংড়ঁৎপবং)। সুতরাং দারিদ্র বিমোচনের পদ্ধতি হিসেবে বিদেশে শ্রমশক্তি বিক্রির ক্ষেত্রে আমাদের নূতনভাবে ভাবতে হবে। সরকারকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে কারণ এ খাত থেকে সরকার বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচ্ছেন (যা একক খাত থেকে সরকারের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন)। সংশ্লিষ্ট এ বিষয়ে আমরা কি এ বিবেচনা মাথায় রাখতে পারি যে এখন থেকে ২০ বছর পরে ইউরোপে ২ কোটি বিদেশী শ্রমশক্তি দরকার হবে; স্বদেশের উন্নয়নের জন্য মানবশক্তি পরিকল্পনা জরুরী; প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তি পরিকল্পিতভাবে বিদেশে পাঠালে অনেক গুণ বেশি লাভ হতে পারে; আর দাতাদের অর্থে বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রিক সভা-সমিতিতে বিদেশ না গেলে কি ক্ষতি(?)।
দারিদ্র হ্রাস নীতি-কৌশলের দারিদ্র; ধনী নিয়ে গবেষণা জরুরি
গ্রাম-শহর নির্বিশেষে আবাসনের দারিদ্র বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি পরিবারের (অর্থাৎ ৫ কোটি মানুষের) নিজ মালিকানাধীন মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এরা বাস করেন গ্রামে, শহরের বস্তিতে (অনেকেই ভাসমান), শিল্প এলাকায়, চরাঞ্চলে, শহরতলীতে ইত্যাদি। এসব মানুষের আবাসনের দারিদ্র যথাসম্ভব দ্রুত দূর করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
দরিদ্র মানুষের সন্তানেরা যে স্কুলে যেতে পারে না অথবা স্কুলে গেলেও কপালে জোটে অতি নিম্মমানের শিক্ষা অথবা শিক্ষা শেষের আগেই স্কুল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়Ñ এ দারিদ্রের কি হবে? এদেশে প্রতি ৩ জন ছাত্রের ১ জন মাদ্রাসার ছাত্র; মাদ্রাসা ছাত্রদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান; মাদ্রাসা পাশ করা ছাত্রদের ৭৫ ভাগই বেকার থাকেÑ শিক্ষার এ দারিদ্রের কি হবে? শিক্ষা তো সাংবিধানিকভাবেই মানব-অধিকারÑ মানুষ তো জন্মসূত্রে এ অধিকার পায়। কিন্তু এতো ঢাক-ঢোল পেটানোর পরে যখন বলা হয় যে বাংলাদেশে এখন প্রায় সবাই স্কুলে যায় তখন দরিদ্র পরিবারের সন্তান-সন্ততিদের কয়জন উচ্চশিক্ষা পেয়েছেন? অবস্থা যা তাতে এভাবে সরাসরি এ প্রশ্ন করাটা অনেকেই আমার আদবের অভাব মনে করতে পারেন। কিন্তু কথাটা তো সত্য।
শ্রমজীবী-দরিদ্র পরিবারের কোন একজন সদস্য-সদস্যার যদি এমন কোন অসুখ হয় যখন অপারেশন করা এবং/অথবা ঔষধ কিনতে অনেক অর্থের প্রয়োজন তখন আসলে অবস্থাটা কী হয়? প্রথমেই যা করতে হয় তা হলো পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ এবং/অথবা সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পদ (যদি থেকে থাকে) এক নিমেষে বিক্রি করতে হয় (যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন “দুর্দশাগ্রস্ততার কারণে সম্পদ বিক্রি”, ফরংঃৎবংং ংধষব)। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কাছে ধার-দেনা করতে হয়। এ হচেছ অনেকটা “নদী ভাঙ্গনেÑ এক রাতে সব কিছু নদীগর্ভে চলে যাবার মত”। এরপর ঐ মেহনতী মানুষটির কাজ থাকলেই কী না থাকলেই কী। “স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি” যদি মানুষের সাংবিধানিক অধিকারই হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সংবিধানের এ বাধ্যবাধকতার বাস্তবায়নে সরকার কী করছে/করে? ব্যাপারটি কি এ রকম যে যতোদিন কালো টাকার মালিকেরা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করবে ততোদিন এসবে কার্যকরী তেমন কিছু হবে না। তাহলে তথাকথিত উন্নয়ন কৌশল, দারিদ্র হ্রাস কৌশল, আর ৬-৭% অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী হবে?
আমার মনে হয় আমাদের নির্মোহভাবে জানা প্রয়োজন এদেশের মানুষ কেন ভিক্ষুক হয়(?); মানুষ কেন নি:স্ব হয়(?); মানুষ কেন রিক্সা-ভ্যান-ঠেলাগাড়ী চালায়(?); শিশুরা কেন কাউরান বাজারে টুকরির মধ্যে ঘুমায়(?); মহিলারা কেন ইট ভাঙ্গে(?) ইত্যাদি। আমার গবেষণায় আমি দেখেছি যে সখ করে কেউই ভিক্ষুক হয় নাÑ আজকের পুরুষ ভিক্ষুকটি প্রথমে ছিলেন গ্রামের কৃষক অথবা আদমজীর শ্রমিক, তারপর চালিয়েছেন রিক্সা, তারপরে হয়েছেন অসুস্থ, আর তারপরেই ভিক্ষুক, আর এখন অসুখ বেড়ে তিনি অকাল মুত্যুর দিকে এগুচ্ছেন। আর আজকের মহিলা ভিক্ষুকটি হয় ঐ পুরুষ ভিক্ষুকের স্ত্রী অথবা গ্রাম থেকে আসা নিঃস্ব একজন মানুষ যিনি ঝি-এর কাজ করেছেন, তারপর এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেছেন, আর এখন অসুস্থতা বেড়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। এসব অকাল মৃত্যুর দায় দায়িত্ব কার? এসব মানুষ নিয়ে “দারিদ্র হ্রাস কৌশল” কি কিছু ভাবছে? আসলে ভাবছে না। সম্ভবত ক্রমবর্দ্ধমান দুর্বৃত্তায়নের কাঠামোতে ভাববারও কথা নয়। “দারিদ্র হ্রাস কৌশলেরই” এ এক মহা দারিদ্র। আমার মনে হয় কিছু মানুষ কেন, কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় অঢেল সম্পদের মালিক হনÑ তা জানলে দারিদ্র-বৈষম্যের কারণও অনেক দূর জানা যাবে। আসলে দারিদ্র নিয়ে যারা সত্যিকার অর্থে চিন্তা ভাবনা-গবেষণা করছেন তাদের এখন ‘ধনী’ নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন।
দারিদ্র বিমোচন ও হ্রাস সন্দেহাতীতভাবে এক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রতিশ্র“তি ও যোগ্যতার প্রশ্ন
রাজনীতিতে নির্ধারক হবে কালোটাকার মালিক আর সরকারে গিয়ে তারা দারিদ্র দূরীকরণ করবে – এ বিশ্বাসের যুক্তি কোথায়? আর সে কারণেই প্রচলিত রাজনীতিবিদরা সরকারে ও সরকারের বাইরে দারিদ্র নিয়ে ব্যবসা করবেন – যা তারা করছেন। এটাই স্বাভাবিক। দারিদ্র দূরীকরণের জন্য হাজারো চুক্তিভিত্তিক প্রকল্প (ঢ়ৎড়লবপঃ) গৃহীত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে; কিন্তু কখনও, কোনও অবস্থাতেই এমন কর্মসূচী (ঢ়ৎড়মৎধসসব) নেয়া হবে না, যেখানে বাজেটের প্রধান অংশ বরাদ্দ করে প্রকৃত দারিদ্রের সকল নির্দেশক (রহফরপধঃড়ৎ অর্থে) ভিত্তিক সময় বেঁধে দিয়ে কর্মকাণ্ড সংবিধানের নির্দেশ মোতাবেক পরিচালিত হবে, ব্যর্থতার শাস্তি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে এবং শাস্তির বিধান কার্যকরী করা হবে। এগুলো হবে না, কারণ সে ক্ষেত্রে লুন্ঠণ প্রক্রিয়া ও বৈষম্য সৃষ্টির সব পথ-ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে। বসের চেয়ারের পিছনে যতদিন তোয়ালে থাকবে ততদিন উপনিবেশিক মানসিকতাও যাবে না, আর সেটা অটুট থাকলে দারিদ্র প্রকল্প লাভজনক ব্যবসা হিসেবেই চিরকাল বহাল থাকবে। চেয়ারের মানুষটির দারিদ্র কিভাবে দূর হবে? দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ফ্লাটের মালিক না হতে পারার দারিদ্র কি ভাবে দূর হবে? আমার মাটির তলায়-উপরের সম্পদ অন্যের হাতে নির্বিঘেœ হস্তান্তর করতে না পারার দারিদ্র কিভাবে দূর হবে?
ছোট মনে বড় কাজ করা সম্ভব নয়; আর আমরা যারা কালোটাকার প্রভুদের মধ্যবিত্ত ভক্ত, তারা মনের দিক থেকে যথেষ্ট মাত্রায় অনাবাসি। আমরা যত না ইহকালে বাস করি, ততোধিক পরকালে। আর ইহকালে পশ্চিমা পাসপোর্ট প্রাপ্তির মুর্খতা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জেঁকে বসেছে। গোলকায়নের গোলকধাঁধায় আমি তো বিশ্বনাগরিক (তৃতীয় শ্রেণীর হলেও)Ñ আমার দেশপ্রেম থেকে বিশ্বপ্রেম জরুরী। সুতরাং, সম্ভবত আরও একবার ভাল করে ভাবতে হবে। ভাবনাকে জাতীয় চিন্তায় রূপ দিতে হবে। দুবৃত্তবেষ্টিত যে সমাজ-অর্থনীতি আমরা সৃষ্টি করেছি, সে কাঠামোতে আদৌ দারিদ্র বিমোচন সম্ভব কি’না, ভেবে দেখতে হবে। ভাবতে হবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রসঙ্গটি; গভীরভাবে ভাবতে হবে মধ্যবিত্তের মানসিক-কাঠামোর রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা। “মুক্ত বাজারÑ দরিদ্র-বান্ধব নয়”। সেই সঙ্গে বিশ্বায়নের তোড়ে মুক্তবাজার ততোধিক দরিদ্র-বিরোধী। ভাবতে হবে, নিজের পায়ের তলায় মাটি শক্তিশালী করার কৌশল নিয়ে। যার ফলে যথাদ্রুত সম্ভব দারিদ্র উচ্ছেদ হবে।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: ‘আই এম এফ’ সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখে না!
“অর্থমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে জবাবদিহি করেন না, তিনি তিন মাস পরপর আইএমএফের কর্তাদের কাছে জবাবদিহি করেন। দেশের নিম্নবিত্ত মানুষ কী দামে চাল, ডাল, তেল, আলু, মুলা, বেগুন খাচ্ছে, তা নিয়ে আইএমএফ কি খুব চিন্তিত মনে হয়? শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও আইএমএফের সেই রেকর্ড নেই।...অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কি কোনো দেশের উদাহরণ দিতে পারবেন, যেখানে আইএমএফের পরামর্শে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি হয়েছে?”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, চালের দাম কি আরো বেশি হওয়া উচিত? প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ২৮৯; বাংলাদেশের অর্থনীতি: সামনে কি সুদিন আসছে? ঐ, পৃ: ২৭৫
আপাতত একটি শেষ প্রশ্নÑ পৃথিবীর কোথাও বিদেশী পরামর্শ ও ঋণে দারিদ্র বিমোচিত হয়েছে কি? এদেশের গ্রামে জন্মে এদেশের মাটিতে মানুষ হয়ে আমাদের দারিদ্রের প্রকৃতি ও দরিদ্র মানুষের চেহারা আমরাই যদি না বুঝি তাহলে ভিনদেশী সাহেবরা তা কিভাবে আমাদের চেয়ে ভাল বুঝবেন? এটা আমার কাছে একদিকে যেমন দুর্বোধ্য, অন্যদিকে অত্যন্ত অপমানজনক। শুনেছি আমাদের ইতোপূর্বে প্রণীত দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র – চড়াবৎঃু জবফঁপঃরড়হ ঝঃৎধঃবমু চধঢ়বৎং বা চজঝচ বিশ্বব্যাংকের নির্দেশ মোতাবেক রচিত হয়েছে। আমাদের দারিদ্র-বৈষম্য হ্রাস মধ্যস্থতাকারী জাতীয় উন্নয়ন নীতি-দর্শন আমাদেরই প্রণয়ন করতে হবে এবং জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে জনগণকে সম্পৃক্ত করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এসব কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত “বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের রাজনৈতিক অর্থনীতি” শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে, ২০০০ সালে। শুধু তাইই নয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ সংশ্লিষ্টরা এক পর্যায়ে যখন এদেশে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণে জোরাজুরি করেছিলো তিনি তখন করলেন ঠিক তার উল্টোটা (সম্প্রসারণমূলক), ফলও হলো ধনাত্মক।
তাহলে করণীয় কি?
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: বাংলাদেশের সমৃদ্ধি-উন্নতির পথে ইঙ্গিত
“বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে শিল্পোন্নয়ন ও কৃষির আধুনিকায়ন।...দরিদ্রদের পক্ষে পরিকল্পিতভাবে সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও দারিদ্র্য তীব্রতর হতে পারে...।...বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে কতো শ্রমিকের জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা ও বেকারত্বের অভিশাপ...। আদমজী বন্ধ করে শুধু একটা কারখানা বন্ধ করা হয়নি, কার্যত একটি জনপদকে উৎখাত করে দেওয়া হয়েছে...। সরকারি বাজেটের ঘাটতি কমলেও জনগণ খুশি হবে না যদি তাদের নিজেদের পারিবারিক বাজেটের ঘাটতি বাড়তেই থাকে।...জনগণ যদি বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে না পারেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের মহতী আদর্শের যে প্রতিফলন হল ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, তেমনি প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাবে।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, কেমন আছেন দেশের গরীব মানুষ? কেমন চলছে অর্থনীতি, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ ২০০৭, পৃ: ১১৭, ১২৩, ১২৬; অর্থনৈতিক সংকট: ব্যর্থতার দায় থেকে মুক্ত হবার জন্য অর্থমন্ত্রীর কৌশল, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ৫৫, ৫৭; প্রজাতন্ত্রের হাল হকিকত কেমন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ৫৩
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে আমরা আমাদের সংবিধান মেনে দারিদ্র উচ্ছেদ ও হ্রাসে দেশোপযোগী নীতি ও কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। সেই সঙ্গে আমি এও মনে করি যে, ঋণ গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রণীত বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত দারিদ্র হ্রাসের কৌশলপত্র (নামকরণটি বেশ নিরপেক্ষ গোছের কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলক) আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি একধরনের অস্বীকৃতি। আমার জানামতে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন বেশ কিছু দেশ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র প্রণয়নে অস্বীকার করেছে। কেউ বলেছে, তাদের সংবিধান আছে এবং তার বিধানের ভিত্তিতে দারিদ্র দূরীকরণ হচ্ছে/হবে; কেউ বলেছে, সংবিধান মেনে যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেটাই তাদের উন্নয়ন কৌশল। আমরা কেন পারছি না? আমার তো দৃঢ় বিশ্বাস আমরা পারি। এ লক্ষ্যে আমার প্রস্তাবনা নিম্নলিখিত ১২-দফা এজেন্ডা বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এ ১২-দফা এজেন্ডাকে বিচ্ছিন্ন দফা হিসেবে নয় দেখতে হবে সমন্বিত সমগ্রক (যড়ষরংঃরপ) হিসেবে। সেই সাথে বাস্তবায়ন হতে হবে একই সাথে, তবে প্রত্যেক দফা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার (ঢ়ৎরড়ৎরঃরুধঃরড়হ) ও পর্যায়ক্রম (ংবয়ঁবহপরহম) বিবেচনায় আনতে হবে। আমার প্রস্তাবিত ১২-দফা এজেন্ডা নিম্নরূপ:
১. বণ্টন ন্যায্যতা নিশ্চিতসহ উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি;
২. অধিকতর কার্যকরী ও উৎপাদনশীল কৃষি;
৩. অধিকহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ ন্যায্য মজুরীর নিশ্চয়তা;
৪. শিল্পায়ন: অনু, ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ (স্ব-কর্মসংস্থানসহ);
৫. কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার;
৬. নারীর ক্ষমতায়ন;
৭. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার;
৮. জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে রূপান্তর (মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ইত্যাদি);
৯. শক্তিশালী সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত;
১০. সুসংগঠিত সামাজিক ইন্স্যুরেন্স সিস্টেম (সেফটি নেট থেকে শস্য বীমা পর্যন্ত);
১১. রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিচারিক সংস্কৃতির গণমুখী রূপান্তর; এবং
১২. রাষ্ট্রিয়-সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের স্বতস্ফুর্ত সক্রিয় অংশগ্রহণ (উন্নয়ন হবে আন্দোলন)।
আমি মনে করি, জনগণের স্বার্থ সবকিছুর উর্দ্ধে। আর দারিদ্রসহ জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বলতে আমরা কী বুঝবো এবং সেগুলো রাষ্ট্র ও সরকার কিভাবে নিশ্চিত করবে তা তো সংবিধানেই আছে। মানুষ হিসাবে দরিদ্র মানুষ সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সমঅংশীদার। আমাদের সংবিধান চল্লিশ বছর আগে মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার যে দিকদর্শন দিয়েছে সেটা বাস্তবায়িত হলে দারিদ্র নিয়ে আর কোনো সেমিনার সিম্পোজিয়াম দরকার হবে না। মনে রাখা জরুরী যে এ দেশের দারিদ্র প্রধানত মনুষ্যসৃষ্টÑভূমিকম্প বা অলৌকিক কোন কিছু এখানে দারিদ্রের কারণ নয়। সুতরাং শেষ কথা, মানুষ যেন জন্মসুত্রে দরিদ্র হতে না পারে, সে শর্ত সৃষ্টি করতে হবে; সকল মানুষ মানুষ হিসাবে সমান। সুতরাং বৈষম্য সৃষ্টির পথ বন্ধ করলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাহলে সমস্যাটি কোথায়?
ভাবনার দারিদ্র যেখানে প্রকট
আবুল বারকাত
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(ই-মেইল: যফৎপ.নফ@মসধরষ.পড়স)
বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর)
আয়োজিত
শাহ এ এম এস কিবরিয়া
স্মারক বক্তৃতা
ঢাকা: বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন
১৪ মাঘ ১৪১৮/২৭ জানুয়ারি ২০১২
প্রাক্কথন
শাহ এ এম এস কিবরিয়ার জনকল্যাণকামী অর্থনীতি দর্শন
“দেশের অর্থনীতি গতিশীল হয়, কর্মসংস্থানের সুযোগে সৃষ্টি হয় এবং প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়Ñ যখন বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ বৃদ্ধি একটি গতিশীল অর্থনীতির চালিকা শক্তি। বিনিয়োগ শুধু শিল্পে বা কৃষিতে নয়; শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ করা হলে তার ফল খুবই ইতিবাচক হয়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি যখন আয়ত্তে থাকে, তখন উচ্চ প্রবৃদ্ধি জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। বস্তুত এই দুই সূচকের সুষম সমন্বয় দেশের অর্থনীতির সার্বিক স্বাস্থ্য ও ভারসাম্যের পরিচায়ক।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতি: সামনে কি সুদিন আসছে? প্রবন্ধ সংগ্রহ: ২০০৭, পৃ: ২৭২
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছিলেন ক্ষমতার আসনে একজন জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যতিক্রমি প্রগতিশীল মানুষ। এ দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কেন যেনো হয় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন অথবা জনমানুষের কল্যাণে জন-সমৃদ্ধির (ঢ়বড়ঢ়ষব'ং বিষষ-নবরহম অর্থে) লক্ষে কর্মকাণ্ড পরিচালনে ব্যর্থ হন। অথচ তারা ক্ষমতার আসন গ্রহণ করেন প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ঐ বিধান মেনে নিয়ে যেখানে সুষ্পষ্ট লেখা আছে “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ” [অনুচ্ছেদ ৭ (১)]। শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছিলেন ব্যতিক্রমি মানুষ এ জন্যেই যে তিনি সংবিধানের এ বিধান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এবং সে বিশ্বাস থেকেই দেশের অর্থনীতি পরিচালন করেছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃতই অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন উষ্ণ হৃদয় দেশপ্রেমিক মানুষ। মানবকল্যাণমুখী অর্থনীতির ভিত্তি প্রসারণে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার জ্ঞান-ভিত্তিক নেতৃত্ব ছিল সত্যিকার অর্থেই অতুলনীয়। আমার মতে তার দেশভাবনার বড় জায়গা জুড়ে ছিলো মুক্ত বাজার অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করেই বৈষম্য হ্রাসকারী উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের দর্শন। আর সে কারণেই তার অর্থনীতি ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বৃহত্তর জনগোষ্ঠি যার অধিকাংশই দরিদ্র-বঞ্চিত। জনকল্যাণকামী এ ভাবনা বাস্তবায়নে তিনি প্রচলিত উন্নয়ন কাঠামোর মধ্যেই বৈষম্য হ্রাস, দারিদ্র নিরসন, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, সামাজিক উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি প্রশস্ত করা, ভূমি সংস্কার, বৈষম্য হ্রাস উদ্দিষ্ট রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতিÑ এসব বিষয়ে বিশেষ জোর দিতেন। এসবই ছিল প্রাথমিক স্তরের পূঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যে জনকল্যাণ নিশ্চিত করার প্রায় অসম্ভব এক প্রয়াসÑ যা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর ছিলেন শাহ কিবরিয়া। অর্থনীতি শাস্ত্রের মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রতীক। আর প্রধানত এ কারণেই আমার মনে হয়েছে দারিদ্র-বঞ্চনা সংশ্লিষ্ট ভাবনাই হওয়া উচিত আজকের স্মারক বক্তৃতার কেন্দ্রিয় বিষয়।
দারিদ্র চিন্তা ও ভাবনার দারিদ্র: কেনো এ প্রসঙ্গ?
পনেরো কোটি মানুষের এদেশে ‘দারিদ্র’ যে সবচে রূঢ় বাস্তবতা এবং সত্যিকার অর্থে উদ্বেগের বিষয়, তাতে কেউই সম্ভবত দ্বিমত পোষণ করবেন না। অতীতেও এ নিয়ে দ্বিমত ছিল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অদূর ভবিষ্যতেও এ উদ্বেগের নিরসন হবে না। এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে সুস্থ-সবল-চেতনাসমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক ভেদহীন মানুষ সৃষ্টিই ছিল আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। কিন্তু তা অর্জিত হয়নি। আর অর্জিত হয়নি দেখেই এখন “রূপকল্প ২০২১” বাস্তবায়ন জন-আকাঙ্খায় রূপান্তরিত হয়েছে যার মর্মবস্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর র্পূতি নাগাদ ২০২১ সালের বাংলাদেশ হবে “অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, উদার-গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র”; ২০২১ সালের বাংলাদেশ হবে স্বল্প-বৈষম্যপূর্ণ মধ্য আয়ের একটি দেশ; ২০২১ সালের বাংলাদেশ হবে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ জ্ঞানভিত্তিক একটি দেশ। তাই মানব-কল্যাণমুখী রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতি গঠনপ্রক্রিয়ায় ‘দারিদ্র’ বিষয়টিকে আমরা বারবার-প্রতিনিয়ত উত্থাপন করতে চাই।
অর্থনীতি শাস্ত্রের মানুষ হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন – উভয় কারণেই দারিদ্র বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন জরুরী বলে মনে করি। আমি মনে করি দারিদ্রের বহুমাত্রিকতা, বিমোচনের শ্লথ গতি এবং সেই সঙ্গে আমাদের দারিদ্র বিষয়ে অন্যদের (অতি)-আগ্রহ ইত্যাদি কারণে বিষয়টির খোলামেলা, যুক্তিনির্ভর, জ্ঞানসমৃদ্ধ মূল্যায়ন-পুনর্মূল্যায়ন এ বিষয়ে সঠিক-সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। ‘দারিদ্র’ বিষয়টি পুনঃউত্থাপন করতে চাই এজন্যও যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে “ভাবনার দারিদ্র” প্রকট; মূল ধারার গবেষকদের দারিদ্র চিন্তায় চিন্তার দারিদ্র প্রকট।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: ‘দারিদ্র্য’ রাজনৈতিক স্লোগান মাত্র
“বিশ্বের প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশে দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়, এতে ব্যতিক্রম নেই বলা যায়। দেশের শাসন পদ্ধতি গণতান্ত্রিক হোক বা না হোক, সব শাসকই দারিদ্র্য বিমোচনের স্লোগান ব্যবহার করে ক্ষমতায় বসেন।....তবে নির্বাচনের সময় দরিদ্র্যের প্রতি দরদের আধিক্য দেখা যায়। কিন্তু দারিদ্র্য দূর করার জন্য অঙ্গীকার প্রায়ই বাস্তবায়িত হয় না।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, কেমন আছেন দেশের গরিব মানুষ? কেমন চলছে অর্থনীতি? নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ: ২০০৭, পৃ: ১১৭
“বাংলাদেশে দারিদ্র” বিষয়ে এ দেশের মানুষের মনে প্রশ্নের শেষ নেই; প্রশ্ন শেষ হবার কোনও শর্তও সৃষ্টি হয়নি। তাই দারিদ্র সংক্রান্ত উদ্বেগ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। হতে পারে উদ্বেগ উদ্বেগই থেকে যাবে। সম্ভবত অনেক প্রশ্নের উত্তর এ মুহূর্তে আমরা পাবো না। কিছু প্রশ্নে মতানৈক্য থাকবে, সেটাও স্বাভাবিক। নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হবে, তা আশার কথা। এসব বিবেচনা থেকে কয়েকটি বিষয় উত্থাপন জরুরী বলে মনে করি। আর সেই সাথে দারিদ্র-বঞ্চনা উচ্ছেদ ও হ্রাসের লক্ষে কিছু সমাধান-ভাবনাও উপস্থাপন করতে চাই।
দারিদ্র আসলে কি? দারিদ্রের মর্মার্থ না জানলে দারিদ্র দূরীকরণ বা হ্রাসকরণ বললে কি বুঝবো?
আমার মনে হয় দারিদ্রের সংজ্ঞায়নে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আত্মপ্রবঞ্চনা করছি। আমরা দরিদ্র মানুষের দৃষ্টিতে দারিদ্র দেখি না। এমনকি আমাদের মতো অদরিদ্রদের দারিদ্র পরিমাপের প্রয়াসও দরিদ্র মানুষের দৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে হয়। কারণ, মাথাপিছু নির্দিষ্ট পরিমাণের আয়, মাথাপিছু ২,১২২ কিলোক্যালরির নীচে খাদ্য ভোগ, সাক্ষরতা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রকৃত নিরক্ষরতা হ্রাস না পাওয়া, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার সুযোগ সৃষ্টি করা (দরিদ্ররা সে সুযোগ গ্রহণ করুক বা না করুক) – দারিদ্র সংজ্ঞায়ন ও পরিমাপণে এসব স্থূলতা অতিক্রম করতে আমরা অক্ষম হয়েছি। আর এসব কারণেই ‘দরিদ্র জন্মসূত্রেই দরিদ্র হতে বাধ্য’ – এ ধারণা আমাদের গবেষকদের বোধের দারিদ্রই নির্দেশ করে। সে কারণেই দারিদ্র দূরীকরণ বা হ্রাসের প্রেসকিপশনগুলোও অনুরূপ স্থূল।
“দারিদ্র” আমার মতে নেহায়েত এক অর্থনৈতিক প্রপঞ্চ নয় যা ‘আয়’ এবং/অথবা ‘খাদ্য পরিভোগ’ দিয়ে মাপা হয়। যেমন বলা হয় Ñ যদি কেউ দৈনিক ৬৭ টাকার কম আয় অথবা ২,১২২ কিলো ক্যালরির কম খাদ্য ভোগ করেন তিনিই দরিদ্র, আর তার অবস্থাটা “দারিদ্র”। দারিদ্র পরিমাপের এ স্থূলতার বিপরীতে আমি মনে করি যা কিছু মানুষের পরিপূর্ণ জীবন প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করে সে সবই দারিদ্রের মানদণ্ড। দারিদ্র হলো সুযোগের অভাব বা সমসুযোগের অভাব। আর বৈষম্য-বঞ্চনা থেকেই এর উৎপত্তি। এ বৈষম্য-বঞ্চনা প্রধানত অর্থনৈতিক হলেও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়।
দারিদ্র বহুমুখী। দারিদ্র হতে পারে আয়ের দারিদ্র, ক্ষুধার দারিদ্র, কর্মহীনতার দারিদ্র, স্বল্প-মজুরীর দারিদ্র, আবাসনের দারিদ্র, শিক্ষার দারিদ্র, স্বাস্থ্যের দারিদ্র, অস্বচ্ছতা-উদ্ভূত দারিদ্র, শিশু দারিদ্র, প্রবীণ মানুষের দারিদ্র, নারী-প্রধান খানার দারিদ্র, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের দারিদ্র, ভাসমান মানুষের দারিদ্র, প্রতিবন্ধী মানুষের দারিদ্র, ‘মঙ্গা’ এলাকার মানুষের দারিদ্র, বহিঃস্থ জনগোষ্ঠির দারিদ্র, বস্তিবাসী ও স্বল্প-আয়ি মানুষের দারিদ্র, পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপর্যয়ের দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা-উদ্ভূত দারিদ্র, প্রান্তিকতা উদ্ভূত দারিদ্র (অনানুষ্ঠানিক সেক্টর, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণ-দলিত, পশ্চাৎপদ-পেশা, চর-হাওর-বাওর-এর মানুষ), রাজনৈতিক দারিদ্র (রাষ্ট্রিয় নীতি-নির্দ্ধারণ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ না করতে পারার কারণে দারিদ্র), রাষ্ট্র-সরকার পরিচালনাকারীদের প্রতি আস্থাহীনতা-উদ্ভূত দারিদ্র, মানস-কাঠামোর (সরহফ ংবঃ) দারিদ্র ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, একজন দরিদ্র মানুষের ক্ষেত্রে উল্লিখিত দারিদ্রের একাধিক রূপ প্রযোজ্য হতে পারে। আমি মনে করি দারিদ্রকে দেখতে হবে সব ধরনের দারিদ্রের পরস্পর সম্পর্কিত যৌথ রূপ হিসেবে যেখানে প্রতিটি রূপ ভিন্ন ভিন্নভাবে দারিদ্রের নির্দিষ্ট অংশকে প্রতিফলিত করে মাত্র। তবে এমনও হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক মুহূর্তে দারিদ্রের কোনো এক বা একাধিক রূপ অন্যসব রূপের তুলনায় অধিক গুরুত্ব বহন করে। সেই সাথে এ কথাটি স্পষ্ট হতে হবে যে দারিদ্র হ’তে পারে তুলনামূলক (ৎবষধঃরাব) অথবা নিরঙ্কুশ (ধনংড়ষঁঃব)। সুতরাং আমার বিশ্বাস ‘দারিদ্র বিমোচন’ বললে আমরা বুঝবো দারিদ্রের কোনো কোনো রূপের তুলনামূলক হ্রাস (ঢ়ড়াবৎঃু ৎবফঁপঃরড়হ)আবার কোন কোনটির নির্মূল বা উচ্ছেদ (ঢ়ড়াবৎঃু বৎধফরপধঃরড়হ)।
আমার সার বক্তব্য এক বাক্যেও শেষ করা যেতে পারে। আর তা হলো: যেহেতু দারিদ্র বিষয়টি শেষ পর্যন্ত শোষণ সৃষ্টিকারী কাঠামো উদ্ভূত (ংঃৎঁপঃঁৎধষ) সেহেতু স্থায়ীভাবে দারিদ্র বিমোচন করতে হলে বর্তমান কাঠামোটি ভেঙ্গে তার জায়গায় নূতন কাঠামো বসাতে হবে; আর যুুক্তিগতভাবেই এ কাজটি পারে দরিদ্র শোষিত মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ। এ বক্তব্যে সাম্যবাদী মতাদর্শের গন্ধ আছে বিধায় অনেকেই বাতিলযোগ্য বিবেচনা করলেও য্ুিক্ত হিসেবে বক্তব্যে ভুল নেই। ভুল-ভ্রান্তি থাকলে তা আছে সময়ের নিরিখে সম্ভাব্যতা বিচারে। সে কারণেই বক্তব্য এক কথায় শেষ করা যাচ্ছে না। বক্তব্য এক কথায় শেষ করা যাবে না এ জন্যেও যে আমরা সবাই মিলে আপাতত ধরেই নিয়েছি যে সম্ভবত: পুঁজিবাদী কাঠামোতেই আমাদের চলতে হবে; ধরেই নিয়েছি যে মাত্রা যাই হোক না কেন মুক্ত বাজার অর্থনীতির আবরণের মধ্যেই দারিদ্র হ্রাস/উচ্ছেদ(?)/বিমোচন হতে পারে; ধরেই নিয়েছি যে আমাদের দেশে বাণিজ্যপুঁজি ও ব্যাপক-বিস্তৃত (বিকাশমান) কালো টাকার পুঁজিকে (যা নিকৃষ্ট পুঁজি; গত ৩৫ বছরে যার পুঞ্জিভূত পরিমাণ হবে আনুমানিক ৭ লাখ কোটি টাকা) যে কোন ভাবে শিল্প পুঁজিতে রূপান্তর করলেই দারিদ্রের অনেক রূপ হাল্কা হয়ে আসবে; ধরেই নিয়েছি যে জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিশ্বায়ন-এর সুযোগ(!) গ্রহণ করতে পারলেও দারিদ্রাবস্থা উপশম হবে ইত্যাদি। এসব ধরে নেয়ার পিছনের যুক্তি কতটা যুক্তিসিদ্ধ ও বাস্তবসম্মত এ নিয়ে আজকের বিতর্ক-আলোচনা নয়। সুতরাং ভুল-শুদ্ধের বিচার না করেই ‘ধরে নেয়া’ অনুসিদ্ধান্ত মেনেই আজকের আলোচনা।
আপতনভিত্তিক দারিদ্র বিচারপদ্ধতি খুবই স্থুল
সরকারী ও দাতাগোষ্ঠির দারিদ্র সংক্রান্ত দলিলপত্র প্রায়ই সরলীকৃত দারিদ্রের আপাতন (রহপরফবহপব ড়ভ ঢ়ড়াবৎঃু)-কে সবচে’ বেশি গুরুত্ব দেয়। এই ভিত্তিতেই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে ১৯৮৫/৮৬ সালের ৫৫.৭ শতাংশ থেকে ২০০৪ সালে ৪০.৪ শতাংশে আর ২০১০ সালে ৩১.৫ শতাংশ (যবধফ পড়ঁহঃ ৎধঃরড় নধংবফ ড়হ উঈও সবঃযড়ফ অর্থাৎ খাদ্য ভোগ: প্রত্যক্ষ ক্যালরি গ্রহণ এর হিসেবে মাথা-গণনা পদ্ধতিতে)। অর্থাৎ সরকারী হিসেবে গত ২৫ বছরে দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। অথচ একই সরকারী দলিল বলছে দরিদ্র মানুষের নিরংকুশ সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ এমনকি সরকারী স্থূল হিসেবকে আমলে নিয়েও স্পষ্ট বলা যায় যে, তুলনামূলক দারিদ্র (শতাংশ হিসেবে) হ্রাস পেলেও মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পেতে থাকবে। তিরিশ বছর আগে ৭০ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বাস করতো। তখন মোট দরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি। এখন সরকারী হিসেবে প্রায় ৩২ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করলেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। এ দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশী। সুতরাং দারিদ্রের আপতন-ভিত্তিক স্থূল হিসেবপত্তরও নির্দেশ করে যে, দেশে দারিদ্র হ্রাস পায় নি। এ কথা আরো সত্য হবে যদি দারিদ্র পরিমাপে ইতোপূর্বে উল্লেখিত দারিদ্রের বিভিন্ন রূপ আমলে নেয়া হয়।
দরিদ্র কে? বাংলাদেশে আসলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কত?
আমার ধারণা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের “রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি” ও “মৌলিক অধিকার” সংক্রান্ত ৮ থেকে ৪৩ পর্যন্ত অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগণের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিতরাই দরিদ্র। এ হিসেবে বাংলাদেশের শতকরা ৮৩ ভাগ মানুষই দরিদ্র। সাংবিধানিক অধিকার (১৯৭২) থেকে বঞ্চিতরাই দরিদ্র। বহুমাত্রিক মানব বঞ্চনা দূরীকরণে আমাদের সংবিধান যে সব অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্র“তি দেয় তা হলো নিম্নরূপ:
১. প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ (অনুচ্ছেদ ৭.১)
২. অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা (অনুচ্ছেদ ১৫.ক)
৩. কর্মের অধিকার; যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কাজের নিশ্চয়তার অধিকার
(অনুচ্ছেদ ১৫.খ)
৪. সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার (অনুচ্ছেদ ১৫.খ)
৫. সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা;... মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ (অনুচ্ছেদ ১৯/১,২)
৬. একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা;.... আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর (অনুচ্ছেদ ১৭ ক,খ)
৭. মেহনতী মানুষকে সকল প্রকার শোষণ থেকে মুক্তি (অনুচ্ছেদ ১৪)
৮. জীবনমানের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে কৃষি বিপ্লব (অনুচ্ছেদ ১৬)
৯. জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ (অনুচ্ছেদ ১০)
১০. মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধÑ নিশ্চিতকরণ (অনুচ্ছেদ ১১)
১১. ....জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না (অনুচ্ছেদ ৩২)
১২. .... কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না (অনুচ্ছেদ ২৮.১)
১৩. আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান (অনুচ্ছেদ ২৭) ।
আমি মনে করি দরিদ্র মানুষেরা বঞ্চিত। আমি মনে করি বঞ্চিতরাই দরিদ্র Ñ এ বঞ্চনা হতে পারে সাংবিধানিক এবং ন্যায়-অধিকার কেন্দ্রিক। আগেই বলেছি খাদ্য-পরিভোগ কেন্দ্রিক দারিদ্র পরিমাপ খুবই স্থুল। শারীরিকভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য পরিভোগ দারিদ্র পরিমাপের ক্ষেত্রে এক ধরনের “গরু-ছাগল” পদ্ধতি। বিপরীতে আমি মনে করি দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত; বস্তুগতÑ আত্মিকÑ আবেগী সম্পদ থেকে বঞ্চিত; যে বঞ্চনা তাদের বেঁচে থাকাÑবিকাশ-সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে; যে বঞ্চনা তাদেরকে করে অধিকারহীন; যা তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি/ক্ষমতাকে বিকশিত হতে দেয় নাÑ ফলে তারা সমাজের “সম-সদস্য” হতে পারেন না এবং তারা পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হন না। আর বস্তুগত, আত্মিক ও আবেগী সম্পদ বলতে আমি যা বুঝি তার নির্দেশকসমূহ হলো নিম্নরূপ (এ সবের পরিমাপ যতই জটিল অথবা দুরুহ হোক না কেনো):
বস্তুগত (সধঃবৎরধষ) সম্পদ = আয়, খাদ্য, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় অভিগম্যতা; খাস জমি-জলা-বনভূমিতে অধিকার;
আত্মিক (ংঢ়রৎরঃঁধষ) সম্পদ = উদ্যোগ, জীবনবোধের পরিপূর্ণতা, আকাঙ্খা, পারস্পরিক সম্পর্ক, আদর্শ মানুষের মডেল;
আবেগী (বসড়ঃরড়হধষ) সম্পদ= ভালোবাসা-সহমর্মিতা, আস্থা-বিশ্বাস, মর্যাদা, গ্রহণযোগ্যতাবোধ, অন্তর্ভুক্তি, ছিটকে না পড়ার বোধ।
উল্লেখ করা জরুরি যে বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক শ্রেণী বিভাজন সংক্রান্ত সংখ্যাতাত্ত্বিক তেমন কোনো গবেষণা চোখে পড়ে না। এ বিবেচনা থেকে মানুষের প্রকৃত আয়, ভূমি মালিকানা এবং কালো-টাকার মালিকানা একীভূত করে জনসংখ্যার শ্রেণী বিভাজনের চেষ্টা করেছি। আমার হিসেবে ১৫ কোটি মানুষের এ দেশে ৯ কোটি ৮৯ লাখ মানুষই (অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ) গরীব মানুষ (দেখুন: সারণি ১ এবং ধনী-দরিদ্র শ্রেণী পিরামিড-ছক ১)। প্রকৃত অর্থে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হবে আরো বেশী। কারণ বাজার অর্থনীতিতে যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় এবং সেই সাথে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় না এবং প্রকৃত আয় হ্রাস পায় তখন নিম্ন-মধ্যবিত্তরাও আসলে দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। এ বিবেচনায় আমার হিসেবে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে ১২ কোটি ৪৩ লাখ মানুষ (অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশ)-ই দরিদ্র। অর্থাৎ দরিদ্র মানুষের প্রকৃত সংখ্যাটি সরকারী হিসেবের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩২ শতাংশ নয়Ñ হবে ৮৩ শতাংশ। এই ৮৩ শতাংশ মানুষই নিরন্তর বঞ্চিত। বঞ্চনা হিসেবে দারিদ্র এক চক্রাকারে বিবর্তিত হচ্ছেÑ যে চক্র চূর্ণ করা কঠিন, যে চক্র কাঠামোগত (ছক ২)। আর সেই সাথে সময়ের নিরিখে আমাদের দেশে দারিদ্র-বঞ্চনা এক ধরনের পাইপ যে পাইপে দরিদ্র হিসেবে ঢুকবার পথ বেশী আর বেরুনোর পথ কম (দেখুন ছক ৩)। দারিদ্র-বঞ্চনার পাইপটি এমন যে একবার ঢুকলে বেরুনো কঠিন; আবার একবার বেরুলে বাইরে থাকাটাও কঠিন (অর্থাৎ আবার ঢুকার সম্ভাবনা অনেক)।
সারণি ১: বাংলাদেশের শ্রেণী কাঠামোয় দরিদ্র মানুষ, ২০১০
(মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ধরে)
(কোটি মানুষ)
গ্রাম/শহর গরীব মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধনী মোট
নিম্ন মধ্য উচ্চ মোট
গ্রাম ৮.০৯ ১.৮২ ০.৯২ ০.৩৪ ৩.০৮ ০.২৩ ১১.৪০
শহর ১.৮০ ০.৭২ ০.৫৪ ০.৩৬ ১.৬২ ০.১৮ ৩.৬০
মোট ৯.৮৯ ২.৫৪ ১.৪৬ ০.৭০ ৪.৭০ ০.৪১ ১৫.০
তথ্য উৎস: প্রবন্ধকার কর্তৃক হিসেবকৃত।
ছক ১: বাংলাদেশে ‘ধনী-দরিদ্র’ শ্রেণী পিরামিড
(২০১০-এ মোট জনসংখ্যা = ১৫ কোটি)
ছক ২: বঞ্চনার চক্র হিসেবে দারিদ্র
ছক ৩: দারিদ্র পাইপ: সময়ভিত্তিক ঢুকা-বেরোনো
সংবিধানকে দরিদ্র পরিমাপণের ভিত্তি হিসেবে ধরলে আমাদের “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক যে জনগণ” (অনুচ্ছেদ ৭.১), তাদের ৮৩ ভাগ দরিদ্র (কয়েকটি নির্দেশক-এর জন্য দেখুন- ছক ৪)। কারণ ১৫ কোটি মানুষের এ দেশে:
ক্স খাদ্য গ্রহণের নিরিখে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি (যা সংবিধানের ১৪ ও ১৫ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী)।
ক্স প্রায় ৯ কোটি মানুষ এখনও কার্যত নিরক্ষর এবং প্রকৃত শিক্ষা-সুযোগ বঞ্চিত (যা সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ, বিশেষত ১৭গ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী )।
ক্স প্রায় ১০ কোটি মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্য-সেবার সুযোগ বঞ্চিত। আর ৭.৫ কোটি মানুষ সুপেয় পানির অভাবে মরণব্যাধি আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত-ঝুঁকির মধ্যে আছেন (যা সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী)।
ক্স প্রতিবছর যে ৯ লাখ মানুষ এদেশে মৃত্যুবরণ করেন তার অর্ধেকই পাঁচ বা আরও কম বয়সের শিশু। আরও লজ্জাজনক কথা, ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ দারিদ্র-উদ্ভূত। নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় মাথাপিছু ব্যয় মাত্র ১৩ টাকা, ডায়ারিয়ার ১৭ টাকা, হামের ১২ টাকা এবং যক্ষ্মার ৯০০ টাকা। উল্লেখ্য, যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান চতুর্থ শীর্ষে (সংবিধানের ১৫ ও ১৮.১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অবস্থা এমন হ্বার কথা নয়)।
ক্স সাক্ষর-নিরক্ষর মিলে প্রায় ৩ কোটি মানুষ (যাদের অধিকাংশই যুবক) এখনও বেকার (সংবিধানের ১৫খ ও ২০ অনুচ্ছেদ কর্মের অধিকার নিশ্চিত করে)।
ক্স প্রায় ১০ কোটি মানুষ এখনও বিদ্যুৎ সুবিধা বঞ্চিত (অথচ সংবিধানের ১৬ ধারা এ সুবিধা নিশ্চিত করে)।
ক্স সীমিত আয়ের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ প্রকৃত অর্থেই দুর্দশাগ্রস্ত এবং দুর্দশা ক্রমবর্দ্ধমান। এর অন্যতম কারণ দ্রব্যমূল্যের (খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভুত) উর্দ্ধগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জিত হয়েছে কিন্তু দরিদ্র মানুষের খাদ্য-পরিভোগ বৃদ্ধি পায়নি। অন্যদিকে বন্টন-অসমতা বৃদ্ধি পেয়েছে (এসবই সংবিধানের ১৩, ১৫ ও ১৯ অনুচ্ছেদ-এর সঙ্গে সাযুজ্যহীন)।
ক্স দেশের অধিকাংশ নারী, শিশু ও প্রবীণ নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত (যা সংবিধানের ১০, ১১, ১৫, ১৭, ১৮ ও ২৮ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী )।
ক্স বিরাট এক জনগোষ্ঠি নিশ্চিতভাবেই উত্তরোত্তর অধিক হারে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছেন (যা সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সকল ধারার পরিপন্থী)।
ক্স ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও আদিবাসী মানুষের বঞ্চনা চিরস্থায়ী রূপ ধারণ করেছে। শত্র“/অর্পিত সম্পত্তি আইনের মারপ্যাচে ইতোমধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫০ লাখ মানুষের ২০ লাখ একর ভূ-সম্পত্তি জবরদখল করা হয়েছে। এই জবরদখলকারীরা আমাদের জনসংখ্যার মাত্র ০.৪ শতাংশ (ক্ষমতাবান/ক্ষমতাধর গোষ্ঠিভুক্ত)। আর ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার আদিবাসীরা কি অর্থনীতি, কি শিক্ষা, কি স্বাস্থ্য – সব দিক থেকেই প্রান্তস্থ (এসব কিছুই সংবিধানের ২৭, ২৮, ও ৪১ অনুচ্ছেদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী )।
ছক ৪: বাংলাদেশে সাংবিধানিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা, ২০১০
(২০১০-এর মোট ১৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে)
সংবিধান দারিদ্রদূরীকরণে যা নিশ্চিত করার কথা বলছে আর বাস্তব-প্রবণতা যা দেখছি, তা থেকে আমার হিসেব মতে মৌলিক চাহিদা পদ্ধতিতে জাতীয় ক্ষেত্রে দারিদ্র বিমোচনে সময় লাগবে ২০০-৩০০ বছর। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। দারিদ্র নিরসন কর্মকাণ্ডে হয় মৌলিক পরিবর্তন নয়তো সংবিধানের ৮ থেকে ৪৩ পর্যন্ত অনুচ্ছেদের আমূল সংশোধন জরুরী (সে ক্ষেত্রে সংবিধানের অন্যান্য ১০৬-টি অনুচ্ছেদেও বিভিন্ন মাত্রায় সংশোধন করতে হবে)। আমার মতে এক্ষেত্রে মধ্যপথের অবকাশ নেই (যদিও আমরা অনেকেই মধ্যপথকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি)। তাহলে দারিদ্র দূরীকরণে যে অবস্থায় আমরা উপনীত হয়েছি, তা বিশ্লেষণ করে এ কথা বলবো কি’না যে, এ বিষয়ে সংবিধান কার্যকরী নয়?
দারিদ্র উচ্ছেদ (বৎধফরপধঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়াবৎঃু), না’কি দারিদ্র হ্রাস (ৎবফঁপঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়াবৎঃু), না’কি দারিদ্র উচ্ছেদ ও হ্রাস উভয়ই?
বিশ্বব্যাংকের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. নিকোলাস স্টার্ন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির লোকবক্তৃতায় বলেছিলেন, “আমার টেবিলে দারিদ্র উচ্ছেদ (ধষষবারধঃরড়হ অর্থে) শিরোনামে কোনও কিছু এলে আমি সেটা ধিংঃব ঢ়ধঢ়বৎ নধংশবঃ -এ ছুড়ে ফেলে দিই”। অর্থাৎ তার মতে দারিদ্র উচ্ছেদ সম্ভব নয়। বক্তব্যটি আমার কাছে অর্থনীতিবিদদের দারিদ্র বিষয়ক দর্শন-চিন্তারই দারিদ্র বলে মনে হয়। দারিদ্র উচ্ছেদ ও দারিদ্র হ্রাস – ধারণাগত দিক থেকে উভয়ই সঠিক। আসলে দারিদ্রের মাত্রা দু'টো – নিরঙ্কুশ দারিদ্র (ধনংড়ষঁঃব ঢ়ড়াবৎঃু) আর আপেক্ষিক বা তুলনামূলক দারিদ্র (ৎবষধঃরাব ঢ়ড়াবৎঃু)। আমি মনে করি, মাথাপিছু ২,১২২ কিলোক্যালরির নীচে ভোগ যদি নিরঙ্কুশ দারিদ্রের একটা মাপিকাঠি হয়, সেক্ষেত্রে এ মুহূর্তেই বাংলাদেশ থেকে নিরঙ্কুশ দারিদ্র উচ্ছেদ (হ্রাস নয়) সম্ভব। কারণ আমরা এখন যে পরিমাণ খাদ্য শস্য (ধান, গম, ডাল, ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংশ ইত্যাদি) উৎপাদন করি সেটাকে মোট কিলোক্যালরিতে রূপান্তর করে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হবে মাথাপিছু প্রায় তিন হাজার কিলোক্যালরি। সহজ এই পাটিগণিত বাস্তবে কাজ না করার প্রধান কারণ হল বণ্টন-বৈষম্য। আর সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ বৈষম্য রাষ্ট্রের মূলনীতির পরিপন্থী। কারণ, বলা হচ্ছে “বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ”। আসলে মূলনীতি শীর্ষক সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা, ১৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতকরণের বিধানসহ কৃষি সংস্কার (ধমৎধৎরধহ ৎবভড়ৎস) ও অন্যান্য জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড (যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি) ছাড়া বণ্টন বৈষম্য রোধের প্রকৃত কোনো উপায় নেই।
নিরঙ্কুশ দারিদ্রের বিপরীতে আপেক্ষিক দারিদ্র উচ্ছেদ বা নির্মূল সম্ভব নয়, হ্রাস সম্ভব। কারণ বিষয়টি তুলনামূলক। এক শ্রেণীতে পাঠরত দু’জনের পরীক্ষার ফল (অথবা জ্ঞান-মাত্রা) ভিন্ন হয় বিভিন্ন কারণে। আবার দু’জনের ফল ভিন্ন হতে বাধ্যÑ এ কথাও অসত্য হতে পারে। দু’জনের প্রথমজন যদি জন্মসূত্রে স্বল্প ওজনের (ষড়ি নরৎঃয বিরমযঃ) এবং সেই সঙ্গে দারিদ্রের কারণে অপুষ্টিবাহিত হয় (বলা হয় জন্ম প্রক্রিয়ার দু’বছরের মধ্যে মস্তিষ্ক কোষের মূল বিকাশ ঘটে থাকে) আর দ্বিতীয়জন যদি ঠিক উল্টো বৈশিষ্ট্যের হয়, তাহলে দু’জনের পরীক্ষার ফল ভিন্ন হবে। আর দু’জনেই অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বাহক হলে (প্রথমজনকে দ্বিতীয়জনের বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত করলে) কি তুলনামূলক ফল ভিন্ন হবে? আমাদের দারিদ্র গবেষকেরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান বলে আমার জানা নেই। তবে আমার বিশ্বাস, অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে পরীক্ষার ফল (অথবা জ্ঞান-মাত্রা) বিষয়ক দারিদ্র হ্রাস নয়, উচ্ছেদই সম্ভব। সুতরাং, সামাজিক বৈষম্য-অবৈষম্যের বিচারে নিরঙ্কুশ দারিদ্র আপেক্ষিক আর আপেক্ষিক (বা তুলনামূলক) দারিদ্র নিরঙ্কুশ। নিরঙ্কুশ ও আপেক্ষিক দারিদ্রের মর্মার্থ অনুধাবনে বিষয়টি আমাদের দারিদ্রাবস্থা বিশ্লেষণ ও দারিদ্র উচ্ছেদ (নির্মূল) এবং/অথবা দারিদ্র হ্রাসের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
দারিদ্র ও উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কিত বিষয়
দারিদ্র ও মানব (মানবিক) উন্নয়ন যে পরস্পর সম্পর্কিত এ বিষয়েও আমাদের চিন্তা কাঠামোতে যথেষ্ট ভ্রান্তি আছে বলে মনে হয়। সরকার ও দাতাগোষ্ঠি প্রায়শই আমাদের বুঝিয়ে থাকেন যে, উন্নয়ন হলে দারিদ্র স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কমে যাবে। আমি মনে করি উল্টো – দারিদ্র উচ্ছেদ হলে উন্নয়ন হবে অথবা দারিদ্র উচ্ছেদ টেকসই উন্নয়নের প্রধান পূর্ব শর্ত। আসলে উন্নয়ন বলতে সরকার ও দাতাগোষ্ঠি যা বুঝিয়ে থাকেন সে অর্থে তা হবে না। তারা উন্নয়ন বলতে মোট উৎপাদনের বৃদ্ধি এবং বৃদ্ধির হার অথবা মাথাপিছু জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: “অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি” মহৌষধ নয়
উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনই যে দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় নয়Ñ এ ভুল ভেঙ্গে গেছে। “বেশ কয়েকটি দেশে দেখা গেলো, প্রবৃদ্ধি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে দারিদ্র্যও তেমনি বেড়েছে। অর্থাৎ অল্পসংখ্যক ব্যক্তি বা পরিবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির ও গড় সম্পদ বৃদ্ধির ফল ভোগ করছে; কিন্তু দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এই সমৃদ্ধির অংশীদার হতে পারছে না। কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে, দরিদ্র্যের সংখ্যাও বাড়ছে।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, কেমন আছেন দেশের গরিব মানুষ? কেমন চলছে অর্থনীতি? নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ: ২০০৭, পৃ: ১১৭
বুঝিয়ে থাকেন। আমি অন্তত ১০০টি দেশের নাম উল্লেখ করতে পারি যে সব দেশে এসব মাপকাঠিতে উন্নয়ন হলেও সেই সঙ্গে দারিদ্র হ্রাস পায়নি, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য ও দারিদ্রের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং দারিদ্র বিমোচন উদ্দিষ্ট ‘উন্নয়ন’-এর নতুন সংজ্ঞা প্রয়োজন। যে সংজ্ঞা বৈষম্য-হ্রাসকারী উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কথা বলবে। যেখানে উন্নয়ন হবে এমন একটি প্রক্রিয়া যা মানুষের চয়নের স্বাধীনতা (ভৎববফড়স ড়ভ পযড়রপব) নিশ্চিত করে, বিস্তৃত করে। এ অর্থে উন্নয়ন হতে হবে স্বাধীনতা মধ্যস্থতাকারী প্রক্রিয়া (ভৎববফড়স সবফরধঃবফ ঢ়ৎড়পবংং) যেখানে জনগণের জন্য পাঁচ ধরনের চয়ন-স্বাধীনতা নিশ্চিত হতে হবে: অর্থনৈতিক সুযোগ (বপড়হড়সরপ ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু), সামাজিক সুবিধাদি (ংড়পরধষ ভধপরষরঃরবং), রাজনৈতিক স্বাধীনতা (ঢ়ড়ষরঃরপধষ ভৎববফড়স), স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা (মঁধৎধহঃবব ড়ভ ঃৎধহংঢ়ধৎবহপু) ও সুরক্ষার বা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা (ঢ়ৎড়ঃবপঃরাব ংবপঁৎরঃু)। উন্নয়ন দর্শন কৌশল যদি এসব স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয় শুধুমাত্র তখনই উন্নয়নের সঙ্গে দারিদ্র বিমোচিত হবে অথবা দারিদ্র বিমোচন টেকসই উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হিসেবে কাজ করবে। মানবিক উন্নয়নের এ দর্শনটি হতে হবে দেশের মাটি-উত্থিত উন্নয়ন দর্শন (যড়সব মৎড়হি ফবাবষড়ঢ়সবহঃ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু) যে দর্শনের মূল ভিত্তি-বিষয়সমূহ হবেÑ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিনির্মাণে সবার সম-সুযোগের নিশ্চয়তা; বহিস্থদের অন্তর্ভুক্তিকরণ (বঞ্চিত, নিঃস্ব, দুস্থ, দুর্দশাগ্রস্ত, দুঃখী মানুষ); মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগের নিশ্চয়তা; মানুষ নিজের জন্য যে জীবন মূল্যবান মনে করেন সে লক্ষ্যে সুযোগের সম্প্রসারণ; অ-স্বাধীনতার সব উৎসমুখ বন্ধ করা; সাংবিধানিক ও ন্যায়-অধিকার-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন; মানুষের অসীম সক্ষমতা বৃদ্ধির সব পথ সম্প্রসারণ; বঞ্চনার-চক্র ভেঙ্গে ফেলা; এবং মানুষের জন্য সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করা। মানবিক উন্নয়নের এ দর্শনে দারিদ্র বিমোচন হবে উন্নয়নের লক্ষ্য, উপলক্ষ নয় (যেটা প্রচলিত চিন্তায় ঠিক উল্টো)।
বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এখন “সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য” (গরষষবহবহহরঁস উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং) নিয়ে ভাবছেন যার প্রথম লক্ষ্য হল “চরম দারিদ্র ও ক্ষুধা নির্মূল করা” (২০১৫ সালের মধ্যে অর্দ্ধেকে নামিয়ে আনা)। জাতিসংঘের গউএ-তে যেহেতু রাষ্ট্র হিসেবে আমরা স্বাক্ষর করেছি সেহেতু আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে শুরু করে দেশের সংশ্লিষ্ট যে কোনো ফোরামে আমরা “দারিদ্র-ক্ষুধা নির্মূল/উচ্ছেদের” কথা জোরেশোরেই বলতে পারি। সেই সাথে অবশ্যই আমাদের বলতে হবে যে জাতিসংঘে যখন আমরা “দারিদ্র নির্মূল”-এ স্বাক্ষর করলাম তখন দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্রে (চজঝচ) অথবা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দলিলে কেন “দারিদ্র হ্রাসের” কথা বলছি। ‘নির্মূল’ ও ‘ হ্রাস’ তো এক কথা নয়। এ দ্বৈততা কেন? একি নেহায়েত দ্বৈততা না’কি কমিটমেন্ট-এর অভাব, প্রতিশ্র“তি ও সদিচ্ছার অভাব? এ বিষয়ে জোরে কথা বলে কী হবে তা জানি না, তবে যুক্তি থাকলে উচ্চকন্ঠ হতে অসুবিধা কোথায়?
সরকারের দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র অথবা পাঁচসালা পরিকল্পনা নিয়ে আমরা দু’ভাবে ভাবতে পারি: প্রথমত: এ দেশের দরিদ্র মানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যা কিছু দারিদ্র বিমোচনে প্রয়োজন ছিল অথচ “ উন্নয়ন নীতি-কৌশল দলিলে” জায়গা পায়নি তা চিহ্নিত করা এবং উচ্চস্বরে বলা। যেমন দেশে ২ কোটি বিঘার বেশী যে খাস জমি ও জলা আছে তা কিভাবে দরিদ্র মানুষের ন্যায্য হিস্যাতে রূপান্তরিত হবে (?); অথবা দরিদ্র বেকারদের (প্রধানত: যুব দারিদ্র) কি হবে (?); অথবা বন্ধ হয়ে যাওয়া শিল্প কল-কারখানা খোলা নিয়ে ভাবনাটা কি?; অথবা গত ৩৫ বছরে বিদেশী ঋণ-অনুদানের প্রায় ২০০,০০০ কোটি টাকার লুটপাট, আর প্রায় ৭০০,০০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকার কি হবে? ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত: দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র অথবা পাঁচসালা পরিকল্পনায় এমন কি আছে যা দিয়ে দরিদ্র মানুষ বুঝবে যে দারিদ্র দূর হচ্ছে (?); বাস্তবায়ন কৌশলগুলো কী এবং তাতে দরিদ্র মানুষ কিভাবে অংশগ্রহণ করবেন? এ ক্ষেত্রে জনকল্যাণমুখী অর্থনীতিবিদদের দায়িত্ব হতে পারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে “নিজস্ব-দেশজ (যড়সব মৎড়হি)” বিস্তারিত দারিদ্র-বৈষম্যহ্রাসমুখী উন্নয়ন দর্শন ও নীতি-কৌশল প্রণয়ন করে সেটা প্রচার করা এবং যুক্তি থাকলে তা গ্রহণে নাগরিক সমাজ ও সরকারকে পরামর্শ দেয়া। আমাদের “নিজস্ব-দেশজ” “দারিদ্র নির্মূল/বিমোচন কৌশল দলিল” প্রণয়ন এ জন্যও দরকার যে সরকারের তথাকথিত “দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র” রচিত হয়েছে বিশ্ব ব্যাংক ও আই এম এফ-এর কনসেশনাল ঋণ পাবার পূর্ব শর্ত হিসেবে যা এ দেশের “মাটি থেকে উত্থিত” (যড়সব মৎড়হি) নয়। এদেশের দরিদ্র মানুষের নিজস্ব “দারিদ্র বিমোচন নীতি-কৌশল দলিল” প্রণয়ন কোন জোর জবরদস্তির বিষয় নয়Ñ এটা দরিদ্র মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার নীতি-কৌশল হিসেবেই ভাবতে হবে।
দারিদ্র বিমোচন লক্ষ্যে ‘উন্নয়ন’-এর রূপরেখা কেমন হবে বিষয়টি সত্যিকার অর্থে এখনও পর্যন্ত আমাদের অজানা। শুধু দারিদ্রের মর্মবস্তুর নিরিখেই নয়, দারিদ্র-বিমোচন লক্ষ্যের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কেমন হতে পারে, এ বিষয়েও আমাদের জ্ঞানের ভিত্তি যথেষ্ট মাত্রায় দুর্বল বলে আমি মনে করি। দারিদ্র বিষয়ক কোন জ্ঞানতত্ত্বের (বঢ়রংঃবসড়ষড়মু) অস্তিত্ব এ দেশে আছে কি’না, সে বিষয়েও আমি সন্দিহান।
দারিদ্রের উৎস—আত্মঘাতি লুণ্ঠন সংস্কৃতি যা বৈষম্য উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে
এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের যুক্তিসংগত তেমন কোনো কারণ নেই যে দারিদ্রের বিস্তৃতি, মাত্রা, গভীরতা ও তীব্রতা এখন যা এবং যে দিকে এগুচ্ছে, প্রবণতার চাকাটি তার উল্টো দিকে আনতে হবে। আর সেটাই হবে আমাদের সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ততা প্রকাশের সর্বোৎকৃষ্ট মানদণ্ড। স্বাধীনতার পরে বিশেষত: ১৯৭৫ পরবর্তী বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে আমাদের দেশে উত্তরোত্তর অধিক হারে দারিদ্র-বৈষম্যের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন (ঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ ধহফ ৎবঢ়ৎড়ফঁপঃরড়হ ড়ভ ঢ়ড়াবৎঃু ধহফ রহবয়ঁধষরঃু) হয়েছে। দারিদ্রের উৎসÑবৈষম্যের বিকাশ হয়েছে অবারিত। বৈষম্য সৃষ্টির উৎসসমূহে কি অর্থনীতি, কি রাজনীতি, কি শিক্ষা-সংস্কৃতি– সর্বত্র এক আত্মঘাতি লুন্ঠন সংস্কৃতি (পঁষঃঁৎব ড়ভ ঢ়ষঁহফবৎরহম) জেঁকে বসেছে। এই লুন্ঠন সংস্কৃতির চরিত্র-নিয়ামক হ’ল কালো টাকা, জবর দখল (ভূমিদস্যু-জলদস্যু-বনদস্যু), সন্ত্রাস, পেশি-শক্তি, ঘুষ, দুর্নীতি, কুশাসন-অপশাসন, দমন-নিপীড়ন ইত্যাদি। পুঁজিবাদ বিকাশে লুণ্ঠন নিয়ামক ভূমিকা পালন করে কিন্তু এদেশে আত্মঘাতি লুণ্ঠণ প্রক্রিয়া জাতীয় পুঁজি বিকাশে ব্যর্থ হয়েছেÑ তা না হ'লে বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজি বন্ধ হবে কেন? কেন বন্ধ হয়েছে মৌলিক ভারী শিল্প? স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭৫ পরবর্তী অর্থনীতির হরিলুটÑ বৈষম্য বৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে “দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদে” (পৎরসরহধষরুধঃরড়হ ঃৎধঢ়) পড়েছে এবং তা থেকে দারিদ্র পুনরুৎপাদিত হচ্ছে এ অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া দারিদ্র বিমোচিত হবে না। বিষয়টি নিম্নরূপ:
ক্স অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কার্যকরী চাহিদা (বভভবপঃরাব ফবসধহফ) বৃদ্ধি করছে; আর ক্রমবর্দ্ধমান রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফাঁদকে উত্তরোত্তর শক্তিশালী করছে। দুর্বৃত্তায়নের এ প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে নবসংযোজন হয়েছে গণমাধ্যম দখল।
ক্স গত তিরিশ বছরে সরকারীভাবে যে প্রায় ২.৫ লাখ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ-সাহায্য এসেছে, তার ৭৫ ভাগ লুন্ঠণ করেছে অর্থনীতি–রাজনীতির দুর্বৃত্ত গোষ্ঠি। ফলে ক্ষমতাধররা অধিকতর ক্ষমতাবান হয়েছেন আর ক্ষমতাহীন দরিদ্রের অক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ক্স ক্ষমতাবানেরা এক ধরনের নিকৃষ্ট পুঁজির (ব্রিফকেস পুঁজি বা কমিশন/দালাল পুঁজি) মালিক হয়েছেন। এ পুঁজি অনুৎপাদনশীল। উৎপাদনশীল বিনিয়োগে এর তেমন আগ্রহ নেই।
ক্স ক্ষমতাবানেরা এখন কালো অর্থনীতির একটা বলয় সৃষ্টি করেছেন, যে দুষ্টচক্রে বছরে এখন ৭৫-৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি হয়, যা জাতীয় আয়ের এক-পঞ্চমাংশ। এ বলয়ে যাদের অবস্থান, তারাই আবার ২৫ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি (লুন্ঠণ সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে ঋণখেলাপি সংস্কৃতি)। এরাই বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত। এরাই বছরে কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ মুদ্রা পাচার (সড়হবু ষধঁহফবৎরহম) করছেন; এরাই অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রে এক ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি করেছেন যেখানে দারিদ্র বিমোচন অসম্ভব। এরাই আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে এবং/অথবা তাকে ব্যবহার করে দারিদ্র বিমোচন কর্মকাণ্ড দুরূহ করছেন।
ক্স অতীতে দেখা গেছে দুর্বৃত্ত-বেষ্টিত সরকার তার বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে যত না মানুষকে গুরুত্ব দিয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে লুন্ঠণের খাতকে। যে পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বিনিয়োগ করে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ মুক্ত করা সম্ভব, তার সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে অপ্রয়োজনীয় অনেক খাতে। বাজেট ঘাটতি হবে অথচ অনুৎপাদনশীল ব্যয় উদ্বৃত্ত হবে। এ ধরনের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত আর যাই হোক দারিদ্র বিমোচন উদ্দিষ্ট নয়।
ক্স ক্ষমতাবান দুর্বৃত্তদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে যা উত্তরোত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও মূল্যবোধ সংশ্লিষ্ট দারিদ্র বৃদ্ধি করছে (যার সবগুলি সংবিধানের ১১, ২৬-২৯, ৩১-৩২, ৩৫-৪১, ৪৩-৪৬ অনুচ্ছেদসমূহের পরিপন্থী)। এসবের পুঞ্জীভূত রূপটি এমনÑ
- যেখানে নির্বাচন মানেই বড় মাপের আর্থিক বিনিয়োগ এবং কালোটাকার প্রতিযোগিতা,
- যেখানে সন্ত্রাস-সহিংসতা অনিবার্য ও নৈমিত্তিক বিষয়,
- যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবমাননা সাধারণ নিয়ম,
- যেখানে সরকারী গণমাধ্যম মানেই স্তুতি প্রচারের যন্ত্র,
- যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ বিষয়টি নেহায়েতই টোকেনইজম (স্লোগান),
- যেখানে সুশাসন বিষয়টি অতিমাত্রায় উচ্চারিত কিন্তু প্রকৃতই মূল্যহীন,
- যেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেহায়েতই কাগুজে,
- যেখানে মানুষের দুর্দশা-বঞ্চনাকেন্দ্রিক ব্যবসা সবচে লাভজনক।
সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, একটি আত্মঘাতি লুন্ঠণ প্রক্রিয়া অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজকে দুর্বৃত্তায়িত করার মাধ্যমে সকল ধরনের বৈষম্য সৃষ্টির ভিত্তি সুদৃঢ় করেছে যা দারিদ্র সৃষ্টিতে পালন করছে কেন্দ্রিয় ভূমিকা। এহেন অবস্থায় দারিদ্র হ্রাস (উচ্ছেদের কথা আপাতত ভুললেও চলবে) আদৌ সম্ভব কি?
দারিদ্রের নতুন মাত্রা সম্পর্কে এদেশে খুব কমই ভাবা হয়
দারিদ্রের কয়েকটি নতুন রূপ যেমন শিশু-দারিদ্র, যুব-দারিদ্র, প্রবীণ-দারিদ্রÑএসব নিয়ে এদেশে এখনও পর্যন্ত তেমন কার্যকর ভাবনা-চিন্তা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে শিশু দারিদ্রের মাত্রা, গভীরতা ও তীব্রতা সামগ্রিক দারিদ্রের চেয়ে বেশি। যুবকদের বিশাল অংশ বেকার। আর যুব-বেকারত্ব সৃষ্টি করছে বিশাল এক বাহিনী যা ব্যবহার করছেন কালোটাকার মালিক, রাজনীতিবিদ এবং ধর্ম-ভিত্তিক জঙ্গীরা। যুবদারিদ্র উদ্ভূত নিরাশা সৃষ্টি করছে বিভিন্ন ধরনের নবতর পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক অস্থিরতা। যুবদারিদ্র নিয়ে বাণিজ্য এখন অনেকের জন্য বেশ লাভজনক।
দারিদ্রের নতুন মাত্রা সৃষ্টি হয়েছে প্রবীণ জনগোষ্ঠির মধ্যেও। একদিকে আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ও যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া (অধিকহারে একক পরিবার সৃষ্টি) আর অন্যদিকে প্রবীণদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের অনিশ্চয়তার ফলে ক্রমবর্দ্ধমান হারে সৃষ্টি হচ্ছে বয়স্ক-দারিদ্র। আমাদের দারিদ্রাবস্থা নিরূপণে দারিদ্রের এ তিনটি নতুন রূপ (শিশু দারিদ্র, যুবদারিদ্র ও বয়স্ক দারিদ্র)–নিশ্চিতভাবেই উপেক্ষিত। এসব নিয়ে হয়ত বা দু’একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়ত বা আরও প্রকল্প হাতে নেয়া হবে। আবারও আমরা প্রস্তর যুগে অনুপ্রবেশ করবো কারণ আরও কয়েকটি প্রকল্পের প্রস্তর ফলক উম্মোচিত হবে। কিন্তু শিশু, যুব ও বয়স্ক-দারিদ্র সৃষ্টির উৎসে হাত দেয়া হবে না।
“সংগঠিত মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট” ও দারিদ্র পুনরুৎপাদন
এদেশে সংগঠিত মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট দারিদ্র পুনরুৎপাদনে অনেক বছর ধরেই জোর ভূমিকা রাখছে। প্রকৃত বাজারের তথ্যের ভিত্তিতে (অর্থাৎ যে দামে মানুষ দ্রব্য/পণ্য কেনেনÑ খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভুত উভয়ই) “সংগঠিত মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট” যে পরিমাণ অর্থ লুট করেছে তা সম্পর্কে আমার হিসেবটি নিম্নরূপ: “সংগঠিত মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট”Ñ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কৃত্রিমভাবে (ধৎঃরভরপরধষষু) বাড়িয়ে গত সরকারের প্রায় ৫ বছরে এ দেশের জনগণের কাছ থেকে মোট ২৮৬,১১০ কোটি টাকা লুট করেছে। মোট লুটের মধ্যে ১৯৩,৮১৭ কোটি টাকা (৬৮%) লুট করেছে খাদ্য-খাতে আর বাদ বাকী ৯২,২৯৩ কোটি টাকা (৩২%) লুট করেছে খাদ্য-বহির্ভূত খাতে। মোট লুটের ৭২ ভাগ হয়েছে গ্রামে আর ২৮ ভাগ হয়েছে শহরে। এ লুটের শিকার হয়েছেন ১ কোটি ৮২ লাখ দরিদ্র পরিবার (৯ কোটি ১০ লাখ মানুষ), ৪৮ লাখ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার (২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ), আর ৩০ লাখ মধ্য-মধ্যবিত্ত পরিবার (১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ)।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
মানুষের অসহায়ত্ব বাড়ায়
“মানুষ বড় সহনশীল প্রাণী। উত্তরমেরুর তুষারবন্দী হয়ে যেমন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, তেমনি আফ্রিকার মরুভূমির রুদ্রতাপেও বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। বিশেষত বেতনের উপর নির্ভর করে যারা চলেন। দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ....। ....কিন্তু চালের দাম যখন বাড়ে, তখন মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, “কাঁচা মরিচ নিয়ে লংকাকাণ্ড: অর্থনীতির বিপর্যয়”, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ২৭৭
মূল্য সন্ত্রাসী সিন্ডিকেট-এর প্রত্যক্ষ শিকার ১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ১৪ কোটি মানুষ (দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত)। ‘মূল্য সন্ত্রাসের’ কারণে দরিদ্র মানুষকে পরিবার চালাতে গিয়ে হয় খাদ্যভোগ কমাতে হয়, অথবা পুষ্টিহীন হতে হয়, অথবা খাদ্য-বহির্ভূত খাতে (বিশেষ করে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা ও শিক্ষায়) ব্যয় কমাতে হয়, অথবা অতীতের সঞ্চয় ভেঙ্গে ফেলতে হয়, অথবা দুর্দশাগ্রস্ততার কারণে সম্পদ (যাই ছিল) বেচতে হয় (ফরংঃৎবংং ংধষব)Ñ অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দরিদ্র মানুষ নিঃস্ব হয়ে ভিক্ষুকে রূপান্তরিত হন। অনেকটাই অনুরূপ অবস্থা হয় নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। আর মধ্য-মধ্যবিত্ত পরিবারÑ যাদের অনেকেই শিক্ষিত কিন্তু বেকারÑএর অবস্থা দ্রুত অধোগতির দিকে নেমে যায়। অতএব, ‘মূল্য সন্ত্রাসের’ এ প্রক্রিয়ায় ১৪ কোটি মানুষের (দেশের ৯৩% মানুষ) দারিদ্র-দুর্দশা-অসহায়ত্ব বৃদ্ধি পায়: দরিদ্র হয় দরিদ্রতর; নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের একাংশ দরিদ্র মানুষের দলে যোগ দিতে বাধ্য হন; আর মধ্য-মধ্যবিত্ত মানুষের একাংশ অবশ্যই নিম্ন-মধ্যবিত্তের দলে যেতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় তথাকথিত “ম্যাক্রো ইকনমিক স্ট্যাবিলিটি” স্রেফ বুদ্ধিবৃত্তিক মার-প্যাচ মাত্র। যেখানে ম্যাক্রো-মাইক্রো অমিল-বেমিল (সরংসধঃপয) বিষয়টি সযতেœ এড়িয়ে যাওয়া হয়।
তথ্য ভিত্তিক আমার হিসেব এ দেশে দুর্বৃত্তায়ন-দুর্নীতি-সন্ত্রাসতত্ত্বকে আরো শক্তিশালী করে Ñ এ বিষয়ে কারো দ্বিধা থাকার কথা নয়। আর অন্যদিকে লুটের এসব হিসেবপত্তর এও নির্দেশ করে যে ওরা প্রচুর কালোটাকার মালিক হয়েছে যার একাংশ তারা লুটপাট তন্ত্র জিইয়ে রাখতে ব্যয় করবে। আবার এ কথাও সত্য যে এত লুট যারা করলোÑ মানুষের ন্যায়-অধিকার বাস্তবায়িত হবার প্রক্রিয়ায় তারা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে?
সংগঠিত সিন্ডিকেটের এসব মূল্য সন্ত্রাসীরা বৃহৎ পর্দার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ঘনিষ্ঠ সহচর মাত্র। সংগঠিত সিন্ডিকেটভিত্তিক এসব মূল্য সন্ত্রাসীরা শুধু চালের মূল্য নিয়েই সন্ত্রাস করে না, এ সন্ত্রাস পিয়াজ-রসুন-ডাল-তেল-গুড়োদুধ-বাস ভাড়া-গ্যাস-পানি-বিদ্যুত-বীজ হয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্ত বিস্তৃত, যার প্রধান শিকার নিঃসন্দেহে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষ। এ ছাড়াও ভুললে চলবে না যে দেশে ইতোমধ্যে মৌলবাদের অর্থনীতির এক শক্ত ভীত সৃষ্টি হয়েছে এবং সেইসাথে মৌলবাদী জঙ্গীত্ব যে ‘আত্মঘাতি বোমা সংস্কৃতি’ চালু করেছে তা জীবনের নিরাপত্তা হ্রাসসহ মজুতদারী-কালোবাজারী বৃদ্ধির মাধ্যমে জনজীবন অধিকতর দুর্বিষহ করছে। নূতন এ অবস্থাটা মূল্য সন্ত্রাস বৃদ্ধির সহায়ক যা দারিদ্র বাড়ায়। সুতরাং মূল্য সন্ত্রাসের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভিত্তি যতদিন থাকবে ততোদিন দ্রব্যমূল্য বাড়বে এবং দারিদ্র-বৈষম্য বাড়বেÑ এ বিষয়ে সন্দেহের যৌক্তিক কোন কারণ নেই। একদিকে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন-সৃষ্ট মূল্য সন্ত্রাস আর অন্যদিকে মৌলবাদী জঙ্গীত্বের কারণে মূল্য সন্ত্রাস বৃদ্ধিÑ দারিদ্র পুনরুৎপাদনের এসব সমীকরণ গভীর ভাবনার বিষয়।
“দুর্নীতি দারিদ্র বাড়ায়” আর “বাংলাদেশ বিশ্বের সবচে’ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ”Ñ ঠিক কি?
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: “দুর্নীতি” নিয়ে ভাবনা!
“দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি কারণ যারা সরকারে থাকেন, তারাই দুর্নীতি করেন কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। এটা সব সরকারের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশন: গোড়ায় গলদ, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ৩৫৮
আমরা এখন শুনতে এবং বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে দুর্নীতি দারিদ্র বাড়ায় এবং বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। কিন্তু এসব বলে দারিদ্রের মূল কারণে না গিয়ে দুর্নীতিকে দারিদ্রের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার (অপ)প্রয়াস আছে। আমি মনে করি এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন সরাসরি উত্থাপন জরুরীÑ তা হলো দুর্নীতি কে বা কারা করেন, কোন গোষ্ঠী করেন? দেশে বছরে যে ৭৫-৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি হয় তাতে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠির মানুষের আদৌ কোন ভাগ আছে কি? দরিদ্র মানুষ কি দুর্নীতি করেন? যদি না করেন তাহলে কারা করেন তা উচ্চকন্ঠে জানান দেয়া দরকার। আর এ কথাটি এখন বলা যেতে পারে যে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দুর্নীতিবাজ শ্রেণী-গোষ্ঠীর হাত থেকে কখনো দুর্নীতি করেননি অর্থাৎ শ্রমজীবী-দরিদ্র মানুষের হাতে ছেড়ে দিলেই তো দুর্নীতি উদ্ভূত দারিদ্র সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। উচ্চস্বরে এ কথা বলতে অসুবিধা কোথায়? না’কি এ বক্তব্য কল্পকথা (ইউটোপিয়া)? পাশাপাশি একথাও তো সত্য যে ফাঁকি না দিয়ে কোথায় শিল্পায়ন হয়েছে? আর শিল্পায়ন ছাড়া কর্মসংস্থান কিভাবে হবে? কিভাবে বাড়বে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি? আমার এ যুক্তি দুর্নীতির পক্ষের যুক্তি নয়Ñ এ যুক্তি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে (যা কখনও দরিদ্র-বান্ধব নয়) শিল্পায়নের পক্ষে দুর্নীতি হ্রাস কৌশল বিনির্মাণের যুক্তি।
দারিদ্র বিমোচনে বিশ্বায়নের সম্ভাব্য ভূমিকা কী হতে পারে?
দারিদ্র দূরীকরণে আঞ্চলিক সহযোগিতাসহ বিশ্বায়ন নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। “দরিদ্রদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে ইচ্ছুক”(!)Ñ এমন অনেক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অনেকেই এখন এসব নিয়ে মুলত দাতাদের পয়সায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে বেশ বিদেশ যাচ্ছেন। দেশের দরিদ্র মানুষদের স্বার্থ উদ্ধারে দেশের ভিতরে কাজের চেয়ে বিদেশমুখীতা ইদানিং বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এসব করে কী লাভ/কার লাভÑ বিষয়টি বেশ দুর্বোধ্য; তবে আমি জানি “বাজার-দরিদ্র বান্ধব নয়”। অবাধ বাজারভিত্তিক বিশ্বায়নের যুগে (যেখানে অসম প্রতিযোগিতা মুখ্য বিষয়, হড়হ-ষবাবষ ঢ়ষধুরহম ভরবষফ) প্রায়শই শুনি যে আমাদের দেশের শ্রমজীবি মানুষকে অবাধে অন্যদেশে শ্রমশক্তি বিক্রির সুযোগ দিলে এ দেশের দারিদ্র দূর হয়ে যাবে। আপাত দৃষ্টিতে যুক্তির কথা বলেই মনে হয়। কিন্তু যখন দেখি প্রত্যন্ত গ্রামের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের তরতাজা একজন যুবক জমি-জমা-সম্পদ-সম্পত্তি বিক্রি করে ২ লাখ টাকা ব্যয় করে ২ বছরের চুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে রাত-দিন পরিশ্রম করে ২ বছরে মোট ২ লাখ টাকা আয় করেন তখন দারিদ্র দূর হল কোথায়? আসলে এসব করে যা হলো তাকে এভাবে বলা চলে “আমাদের ঐ যুবকটি মধ্যপ্রাচ্যে ২ লাখ টাকার সমপরিমাণ বিনিয়োগ করলো যার রিটার্ন শূন্য অথবা নেগেটিভ” অর্থাৎ “মধ্যপ্রাচ্যে আমরা ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট করলাম যার নেট রিটার্ন পাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য”। এ তো সম্পদ হাত ছাড়া হবার এক নূতন পদ্ধতি মাত্র (হবঃ ফৎধরহ ড়ভ ৎবংড়ঁৎপবং)। সুতরাং দারিদ্র বিমোচনের পদ্ধতি হিসেবে বিদেশে শ্রমশক্তি বিক্রির ক্ষেত্রে আমাদের নূতনভাবে ভাবতে হবে। সরকারকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে কারণ এ খাত থেকে সরকার বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচ্ছেন (যা একক খাত থেকে সরকারের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন)। সংশ্লিষ্ট এ বিষয়ে আমরা কি এ বিবেচনা মাথায় রাখতে পারি যে এখন থেকে ২০ বছর পরে ইউরোপে ২ কোটি বিদেশী শ্রমশক্তি দরকার হবে; স্বদেশের উন্নয়নের জন্য মানবশক্তি পরিকল্পনা জরুরী; প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তি পরিকল্পিতভাবে বিদেশে পাঠালে অনেক গুণ বেশি লাভ হতে পারে; আর দাতাদের অর্থে বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্রিক সভা-সমিতিতে বিদেশ না গেলে কি ক্ষতি(?)।
দারিদ্র হ্রাস নীতি-কৌশলের দারিদ্র; ধনী নিয়ে গবেষণা জরুরি
গ্রাম-শহর নির্বিশেষে আবাসনের দারিদ্র বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি পরিবারের (অর্থাৎ ৫ কোটি মানুষের) নিজ মালিকানাধীন মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। এরা বাস করেন গ্রামে, শহরের বস্তিতে (অনেকেই ভাসমান), শিল্প এলাকায়, চরাঞ্চলে, শহরতলীতে ইত্যাদি। এসব মানুষের আবাসনের দারিদ্র যথাসম্ভব দ্রুত দূর করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
দরিদ্র মানুষের সন্তানেরা যে স্কুলে যেতে পারে না অথবা স্কুলে গেলেও কপালে জোটে অতি নিম্মমানের শিক্ষা অথবা শিক্ষা শেষের আগেই স্কুল পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়Ñ এ দারিদ্রের কি হবে? এদেশে প্রতি ৩ জন ছাত্রের ১ জন মাদ্রাসার ছাত্র; মাদ্রাসা ছাত্রদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান; মাদ্রাসা পাশ করা ছাত্রদের ৭৫ ভাগই বেকার থাকেÑ শিক্ষার এ দারিদ্রের কি হবে? শিক্ষা তো সাংবিধানিকভাবেই মানব-অধিকারÑ মানুষ তো জন্মসূত্রে এ অধিকার পায়। কিন্তু এতো ঢাক-ঢোল পেটানোর পরে যখন বলা হয় যে বাংলাদেশে এখন প্রায় সবাই স্কুলে যায় তখন দরিদ্র পরিবারের সন্তান-সন্ততিদের কয়জন উচ্চশিক্ষা পেয়েছেন? অবস্থা যা তাতে এভাবে সরাসরি এ প্রশ্ন করাটা অনেকেই আমার আদবের অভাব মনে করতে পারেন। কিন্তু কথাটা তো সত্য।
শ্রমজীবী-দরিদ্র পরিবারের কোন একজন সদস্য-সদস্যার যদি এমন কোন অসুখ হয় যখন অপারেশন করা এবং/অথবা ঔষধ কিনতে অনেক অর্থের প্রয়োজন তখন আসলে অবস্থাটা কী হয়? প্রথমেই যা করতে হয় তা হলো পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ এবং/অথবা সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পদ (যদি থেকে থাকে) এক নিমেষে বিক্রি করতে হয় (যাকে অর্থনীতিবিদরা বলেন “দুর্দশাগ্রস্ততার কারণে সম্পদ বিক্রি”, ফরংঃৎবংং ংধষব)। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের কাছে ধার-দেনা করতে হয়। এ হচেছ অনেকটা “নদী ভাঙ্গনেÑ এক রাতে সব কিছু নদীগর্ভে চলে যাবার মত”। এরপর ঐ মেহনতী মানুষটির কাজ থাকলেই কী না থাকলেই কী। “স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি” যদি মানুষের সাংবিধানিক অধিকারই হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সংবিধানের এ বাধ্যবাধকতার বাস্তবায়নে সরকার কী করছে/করে? ব্যাপারটি কি এ রকম যে যতোদিন কালো টাকার মালিকেরা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করবে ততোদিন এসবে কার্যকরী তেমন কিছু হবে না। তাহলে তথাকথিত উন্নয়ন কৌশল, দারিদ্র হ্রাস কৌশল, আর ৬-৭% অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী হবে?
আমার মনে হয় আমাদের নির্মোহভাবে জানা প্রয়োজন এদেশের মানুষ কেন ভিক্ষুক হয়(?); মানুষ কেন নি:স্ব হয়(?); মানুষ কেন রিক্সা-ভ্যান-ঠেলাগাড়ী চালায়(?); শিশুরা কেন কাউরান বাজারে টুকরির মধ্যে ঘুমায়(?); মহিলারা কেন ইট ভাঙ্গে(?) ইত্যাদি। আমার গবেষণায় আমি দেখেছি যে সখ করে কেউই ভিক্ষুক হয় নাÑ আজকের পুরুষ ভিক্ষুকটি প্রথমে ছিলেন গ্রামের কৃষক অথবা আদমজীর শ্রমিক, তারপর চালিয়েছেন রিক্সা, তারপরে হয়েছেন অসুস্থ, আর তারপরেই ভিক্ষুক, আর এখন অসুখ বেড়ে তিনি অকাল মুত্যুর দিকে এগুচ্ছেন। আর আজকের মহিলা ভিক্ষুকটি হয় ঐ পুরুষ ভিক্ষুকের স্ত্রী অথবা গ্রাম থেকে আসা নিঃস্ব একজন মানুষ যিনি ঝি-এর কাজ করেছেন, তারপর এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেছেন, আর এখন অসুস্থতা বেড়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। এসব অকাল মৃত্যুর দায় দায়িত্ব কার? এসব মানুষ নিয়ে “দারিদ্র হ্রাস কৌশল” কি কিছু ভাবছে? আসলে ভাবছে না। সম্ভবত ক্রমবর্দ্ধমান দুর্বৃত্তায়নের কাঠামোতে ভাববারও কথা নয়। “দারিদ্র হ্রাস কৌশলেরই” এ এক মহা দারিদ্র। আমার মনে হয় কিছু মানুষ কেন, কিভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় অঢেল সম্পদের মালিক হনÑ তা জানলে দারিদ্র-বৈষম্যের কারণও অনেক দূর জানা যাবে। আসলে দারিদ্র নিয়ে যারা সত্যিকার অর্থে চিন্তা ভাবনা-গবেষণা করছেন তাদের এখন ‘ধনী’ নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন।
দারিদ্র বিমোচন ও হ্রাস সন্দেহাতীতভাবে এক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রতিশ্র“তি ও যোগ্যতার প্রশ্ন
রাজনীতিতে নির্ধারক হবে কালোটাকার মালিক আর সরকারে গিয়ে তারা দারিদ্র দূরীকরণ করবে – এ বিশ্বাসের যুক্তি কোথায়? আর সে কারণেই প্রচলিত রাজনীতিবিদরা সরকারে ও সরকারের বাইরে দারিদ্র নিয়ে ব্যবসা করবেন – যা তারা করছেন। এটাই স্বাভাবিক। দারিদ্র দূরীকরণের জন্য হাজারো চুক্তিভিত্তিক প্রকল্প (ঢ়ৎড়লবপঃ) গৃহীত হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে; কিন্তু কখনও, কোনও অবস্থাতেই এমন কর্মসূচী (ঢ়ৎড়মৎধসসব) নেয়া হবে না, যেখানে বাজেটের প্রধান অংশ বরাদ্দ করে প্রকৃত দারিদ্রের সকল নির্দেশক (রহফরপধঃড়ৎ অর্থে) ভিত্তিক সময় বেঁধে দিয়ে কর্মকাণ্ড সংবিধানের নির্দেশ মোতাবেক পরিচালিত হবে, ব্যর্থতার শাস্তি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে এবং শাস্তির বিধান কার্যকরী করা হবে। এগুলো হবে না, কারণ সে ক্ষেত্রে লুন্ঠণ প্রক্রিয়া ও বৈষম্য সৃষ্টির সব পথ-ঘাট বন্ধ হয়ে যাবে। বসের চেয়ারের পিছনে যতদিন তোয়ালে থাকবে ততদিন উপনিবেশিক মানসিকতাও যাবে না, আর সেটা অটুট থাকলে দারিদ্র প্রকল্প লাভজনক ব্যবসা হিসেবেই চিরকাল বহাল থাকবে। চেয়ারের মানুষটির দারিদ্র কিভাবে দূর হবে? দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ফ্লাটের মালিক না হতে পারার দারিদ্র কি ভাবে দূর হবে? আমার মাটির তলায়-উপরের সম্পদ অন্যের হাতে নির্বিঘেœ হস্তান্তর করতে না পারার দারিদ্র কিভাবে দূর হবে?
ছোট মনে বড় কাজ করা সম্ভব নয়; আর আমরা যারা কালোটাকার প্রভুদের মধ্যবিত্ত ভক্ত, তারা মনের দিক থেকে যথেষ্ট মাত্রায় অনাবাসি। আমরা যত না ইহকালে বাস করি, ততোধিক পরকালে। আর ইহকালে পশ্চিমা পাসপোর্ট প্রাপ্তির মুর্খতা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জেঁকে বসেছে। গোলকায়নের গোলকধাঁধায় আমি তো বিশ্বনাগরিক (তৃতীয় শ্রেণীর হলেও)Ñ আমার দেশপ্রেম থেকে বিশ্বপ্রেম জরুরী। সুতরাং, সম্ভবত আরও একবার ভাল করে ভাবতে হবে। ভাবনাকে জাতীয় চিন্তায় রূপ দিতে হবে। দুবৃত্তবেষ্টিত যে সমাজ-অর্থনীতি আমরা সৃষ্টি করেছি, সে কাঠামোতে আদৌ দারিদ্র বিমোচন সম্ভব কি’না, ভেবে দেখতে হবে। ভাবতে হবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রসঙ্গটি; গভীরভাবে ভাবতে হবে মধ্যবিত্তের মানসিক-কাঠামোর রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা। “মুক্ত বাজারÑ দরিদ্র-বান্ধব নয়”। সেই সঙ্গে বিশ্বায়নের তোড়ে মুক্তবাজার ততোধিক দরিদ্র-বিরোধী। ভাবতে হবে, নিজের পায়ের তলায় মাটি শক্তিশালী করার কৌশল নিয়ে। যার ফলে যথাদ্রুত সম্ভব দারিদ্র উচ্ছেদ হবে।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: ‘আই এম এফ’ সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখে না!
“অর্থমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে জবাবদিহি করেন না, তিনি তিন মাস পরপর আইএমএফের কর্তাদের কাছে জবাবদিহি করেন। দেশের নিম্নবিত্ত মানুষ কী দামে চাল, ডাল, তেল, আলু, মুলা, বেগুন খাচ্ছে, তা নিয়ে আইএমএফ কি খুব চিন্তিত মনে হয়? শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কোথাও আইএমএফের সেই রেকর্ড নেই।...অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কি কোনো দেশের উদাহরণ দিতে পারবেন, যেখানে আইএমএফের পরামর্শে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি হয়েছে?”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, চালের দাম কি আরো বেশি হওয়া উচিত? প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ২৮৯; বাংলাদেশের অর্থনীতি: সামনে কি সুদিন আসছে? ঐ, পৃ: ২৭৫
আপাতত একটি শেষ প্রশ্নÑ পৃথিবীর কোথাও বিদেশী পরামর্শ ও ঋণে দারিদ্র বিমোচিত হয়েছে কি? এদেশের গ্রামে জন্মে এদেশের মাটিতে মানুষ হয়ে আমাদের দারিদ্রের প্রকৃতি ও দরিদ্র মানুষের চেহারা আমরাই যদি না বুঝি তাহলে ভিনদেশী সাহেবরা তা কিভাবে আমাদের চেয়ে ভাল বুঝবেন? এটা আমার কাছে একদিকে যেমন দুর্বোধ্য, অন্যদিকে অত্যন্ত অপমানজনক। শুনেছি আমাদের ইতোপূর্বে প্রণীত দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র – চড়াবৎঃু জবফঁপঃরড়হ ঝঃৎধঃবমু চধঢ়বৎং বা চজঝচ বিশ্বব্যাংকের নির্দেশ মোতাবেক রচিত হয়েছে। আমাদের দারিদ্র-বৈষম্য হ্রাস মধ্যস্থতাকারী জাতীয় উন্নয়ন নীতি-দর্শন আমাদেরই প্রণয়ন করতে হবে এবং জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করে জনগণকে সম্পৃক্ত করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এসব কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত “বৈদেশিক ঋণ-অনুদানের রাজনৈতিক অর্থনীতি” শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে, ২০০০ সালে। শুধু তাইই নয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ সংশ্লিষ্টরা এক পর্যায়ে যখন এদেশে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণে জোরাজুরি করেছিলো তিনি তখন করলেন ঠিক তার উল্টোটা (সম্প্রসারণমূলক), ফলও হলো ধনাত্মক।
তাহলে করণীয় কি?
শাহ এ এম এস কিবরিয়া: বাংলাদেশের সমৃদ্ধি-উন্নতির পথে ইঙ্গিত
“বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে শিল্পোন্নয়ন ও কৃষির আধুনিকায়ন।...দরিদ্রদের পক্ষে পরিকল্পিতভাবে সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও দারিদ্র্য তীব্রতর হতে পারে...।...বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে কতো শ্রমিকের জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা ও বেকারত্বের অভিশাপ...। আদমজী বন্ধ করে শুধু একটা কারখানা বন্ধ করা হয়নি, কার্যত একটি জনপদকে উৎখাত করে দেওয়া হয়েছে...। সরকারি বাজেটের ঘাটতি কমলেও জনগণ খুশি হবে না যদি তাদের নিজেদের পারিবারিক বাজেটের ঘাটতি বাড়তেই থাকে।...জনগণ যদি বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে না পারেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের মহতী আদর্শের যে প্রতিফলন হল ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, তেমনি প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাবে।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া, কেমন আছেন দেশের গরীব মানুষ? কেমন চলছে অর্থনীতি, নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ ২০০৭, পৃ: ১১৭, ১২৩, ১২৬; অর্থনৈতিক সংকট: ব্যর্থতার দায় থেকে মুক্ত হবার জন্য অর্থমন্ত্রীর কৌশল, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ৫৫, ৫৭; প্রজাতন্ত্রের হাল হকিকত কেমন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ২০০৭, পৃ: ৫৩
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আন্তরিক ইচ্ছা থাকলে আমরা আমাদের সংবিধান মেনে দারিদ্র উচ্ছেদ ও হ্রাসে দেশোপযোগী নীতি ও কৌশল প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। সেই সঙ্গে আমি এও মনে করি যে, ঋণ গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রণীত বিশ্বব্যাংকের তথাকথিত দারিদ্র হ্রাসের কৌশলপত্র (নামকরণটি বেশ নিরপেক্ষ গোছের কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলক) আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি একধরনের অস্বীকৃতি। আমার জানামতে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন বেশ কিছু দেশ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে দারিদ্র হ্রাস কৌশলপত্র প্রণয়নে অস্বীকার করেছে। কেউ বলেছে, তাদের সংবিধান আছে এবং তার বিধানের ভিত্তিতে দারিদ্র দূরীকরণ হচ্ছে/হবে; কেউ বলেছে, সংবিধান মেনে যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করা হচ্ছে, সেটাই তাদের উন্নয়ন কৌশল। আমরা কেন পারছি না? আমার তো দৃঢ় বিশ্বাস আমরা পারি। এ লক্ষ্যে আমার প্রস্তাবনা নিম্নলিখিত ১২-দফা এজেন্ডা বাস্তবায়নে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এ ১২-দফা এজেন্ডাকে বিচ্ছিন্ন দফা হিসেবে নয় দেখতে হবে সমন্বিত সমগ্রক (যড়ষরংঃরপ) হিসেবে। সেই সাথে বাস্তবায়ন হতে হবে একই সাথে, তবে প্রত্যেক দফা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার (ঢ়ৎরড়ৎরঃরুধঃরড়হ) ও পর্যায়ক্রম (ংবয়ঁবহপরহম) বিবেচনায় আনতে হবে। আমার প্রস্তাবিত ১২-দফা এজেন্ডা নিম্নরূপ:
১. বণ্টন ন্যায্যতা নিশ্চিতসহ উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি;
২. অধিকতর কার্যকরী ও উৎপাদনশীল কৃষি;
৩. অধিকহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ ন্যায্য মজুরীর নিশ্চয়তা;
৪. শিল্পায়ন: অনু, ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ (স্ব-কর্মসংস্থানসহ);
৫. কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার;
৬. নারীর ক্ষমতায়ন;
৭. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার;
৮. জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে রূপান্তর (মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ইত্যাদি);
৯. শক্তিশালী সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত;
১০. সুসংগঠিত সামাজিক ইন্স্যুরেন্স সিস্টেম (সেফটি নেট থেকে শস্য বীমা পর্যন্ত);
১১. রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিচারিক সংস্কৃতির গণমুখী রূপান্তর; এবং
১২. রাষ্ট্রিয়-সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের স্বতস্ফুর্ত সক্রিয় অংশগ্রহণ (উন্নয়ন হবে আন্দোলন)।
আমি মনে করি, জনগণের স্বার্থ সবকিছুর উর্দ্ধে। আর দারিদ্রসহ জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বলতে আমরা কী বুঝবো এবং সেগুলো রাষ্ট্র ও সরকার কিভাবে নিশ্চিত করবে তা তো সংবিধানেই আছে। মানুষ হিসাবে দরিদ্র মানুষ সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সমঅংশীদার। আমাদের সংবিধান চল্লিশ বছর আগে মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার যে দিকদর্শন দিয়েছে সেটা বাস্তবায়িত হলে দারিদ্র নিয়ে আর কোনো সেমিনার সিম্পোজিয়াম দরকার হবে না। মনে রাখা জরুরী যে এ দেশের দারিদ্র প্রধানত মনুষ্যসৃষ্টÑভূমিকম্প বা অলৌকিক কোন কিছু এখানে দারিদ্রের কারণ নয়। সুতরাং শেষ কথা, মানুষ যেন জন্মসুত্রে দরিদ্র হতে না পারে, সে শর্ত সৃষ্টি করতে হবে; সকল মানুষ মানুষ হিসাবে সমান। সুতরাং বৈষম্য সৃষ্টির পথ বন্ধ করলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাহলে সমস্যাটি কোথায়?