Followers

Saturday, June 16, 2012

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের রাজনীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর ষড়যন্ত্রঃ মোকাবেলায় প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম : মোনায়েম সরকার

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের রাজনীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর ষড়যন্ত্রঃ
মোকাবেলায় প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম
 মোনায়েম সরকার
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একঝাঁক স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে-  যার অপর নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতার দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রাম এবং সবশেষে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, মূল্যবোধ ও আদর্শকেই আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে মনে করি।
পৃথিবীর সব স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীই কতগুলো স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শকে সামনে রেখেই জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে লড়াই-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। আমাদের সেই আদর্শ ছিল- স্বশাসন, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্ড়্গৃতিক-  তথা সার্বিক মুক্তি। বাংলাদেশের সংগ্রাম তাই একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ’৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। শুধু একটি পতাকার পরিবর্তনের জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। পাকিস্তান যে মতাদর্শ নিয়ে সাম্প্র্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং সামরিক স্বৈরশাসনের ধারায় চলেছিল, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। শত বছরের ধারাবাহিকতায় ও বহু গণসংগ্রামে অসংখ্য মানুষের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন, আদর্শ এবং লক্ষ্যগুলো ধীরে ধীরে দানা বেঁধে সৃষ্টি হয় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মূলধারার রাজনৈতিক শক্তির-  যাকে আমরা বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি হিসেবে জানি।
আমরা স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রম করছি। কিন্তু সেই চেতনা, স্বপ্ন বা আদর্শ আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জিত হয়নি। এখনও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী একটি মৌলবাদী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কাছে আমাদের মূলধারা তথা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতি বার বার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মূলধারার চেতনার পক্ষের শক্তি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অর্জিত বিজয়কে সংহত করতে পারছে না। আমাদের জাতীয় জীবনে নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় ট্রাজেডি এবং ক্ষত। স্বাধীনতার এই চার দশক পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক দলগুলোর আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মত ও পথ নিয়ে নানা বিভ্রান্তির ফলে বহু রক্তক্ষরণ হয়েছে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে, সশস্ত্র বিপ্লবের নামে, কখনো বা নকশালবাড়ি আন্দোলনের নামে। কেন তারা সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না? কেন তারা সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন-সাধ পূরণ করতে পারছে না? কেন অশুভ রাজনীতির অবসান হচ্ছে না? এর জন্য এদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মুক্তিকামী মানুষকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? যে সব দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বার বার মূলধারার রাজনীতিকে ক্ষত-বিক্ষত করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে আর কত সময় লাগবে? 
 ধর্মাশ্রয়ী বৈষমম্যমূলক সংকীর্ণ পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট রাজনীতির উন্মেষ
আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক ভাবধারাপুষ্ট রাজনীতির শিকড় প্রোথিত আছে অতীতের গভীরে, ভারত-বিভাগকালে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালির ওপর একটি বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জারি রেখেছিল। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থনৈতিক বরাদ্দের প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালিকে সমানুপাতিক ন্যায্য পাওনা থেকে বরাবর বঞ্চিত করেছে পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলো। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ করেছে বাঙালি জনগোষ্ঠী, সংগ্রাম করেছে একটি বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
সংস্ড়্গৃতির প্রশ্নেও বাঙালির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত আত্মপরিচয় বিকাশের অন্তরায় হিসেবে সক্রিয় থেকেছে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। পাকিস্তানি মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশ হিসেবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা ও দাবি ছিল বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালির এই ন্যায্য দাবিকে কখনো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, কখনো রাজনৈতিক ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে অবজ্ঞা করেছে। বাঙালির এই জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাকে পাকিস্তানের ইসলামি চেতনা বিরোধী ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে দাবিয়ে রাখার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পাঞ্জাবি শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যে-কোনো ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবিকেই ওরা ‘ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা নামঞ্জুর করার অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী পন্থা অবলম্বন করেছে। স্বভাবতই বাঙালি তার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ ইতিহাসবোধ থেকেই ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির বিপরীতে সেকুøলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষাবলম্বন করেছে। ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে ব্যক্তিজীবনের একান্ত অঙ্গনে নিরাপদ রাখাই উত্তম মনে করেছে। ধর্ম ও রাজনীতি-  উভয়ের জন্যই তা মঙ্গলজনক মনে করেছে বাঙালি জনগোষ্ঠী।
পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্ড়্গৃতিক কোনো আকাঙ্ক্ষার প্রতিই যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেনি। ফলে পাকিস্তানি জমানার প্রায় পুরো সময়টাই বাঙালি তার ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা ও দাবি    বাস্তবায়নের সংগ্রামে মুখর ছিল। তিক্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্ড়্গৃতিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বাঙালির ভেতর জাতিগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্ড়্গৃতিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে। এটা কোনো ইতিহাসবিচ্ছিন্ন বিমূর্ত ধারণার বিষয় নয়। এইসব পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বাঙালি। ছিনিয়ে আনে নির্বাচনী বিজয়। বাঙালি জাতির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ। তাই সত্তরের নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণ করে  আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ার নিয়মতান্ত্রিক পথ প্রশস্ত করে। কিন্তু সেই প্রশস্ত পথে ফের কাঁটা বিছিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। পাকিস্তানপ্রেমী ধর্মবাদীদের পরাজয় ঘটে। কিন্তু এই কুচক্রীরা তাদের পরাজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয় সহজে মেনে নিতে পারেনি। সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বার বার আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। ষড়যন্ত্র-খুন-হত্যা ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের সব উপাত্ত-উপাদান ও অঙ্গীকার ধ্বংস করার অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। দেশি-বিদেশি সেই পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্রের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়াটা আজ আমাদের ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশে পরিণত হয়েছে।

পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির পুনঃপ্রবেশ
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতোদ্যম না হয়ে বরং দেশি-বিদেশি চক্র বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র নতুন করে শুরু করে। পরাজিত পাকিস্তানি ও তাদের মিত্রদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু আত্মগোপনে থাকা জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগীরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য তৎপরতা চালায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকেও তখন ঐক্যবদ্ধ রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। উল্টো স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল এবং মেধাবী বলে পরিচিত একটি অংশ মূল দল থেকে বেরিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ ্লোগান দিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ গঠন করে। তীব্র মুজিববিরোধী ভূমিকা নিয়ে চটকদার সব বক্তব্য দিয়ে তারা যে হটকারী রাজনীতি শুরু করে তাতে দেশের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ বিভ্রান্ত হয়েছে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক দলগুলোও স্বাধীন দেশে সরকার বিরোধিতা করার মঞ্চ পেয়ে যায়। জাসদ তৈরি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে দুর্বল করার একটি ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ। তাছাড়া পাকিস্তান ফেরৎ সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীতে আত্মীকরণ করাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থের টানাপড়নের কারণে সেনাবাহিনীর ভেতরেও দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদের অনুকূলে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের কেউ কেউ পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে হাত মেলায়।
একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন কাজ, অন্যদিকে ঘরে-বাইরে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে সরকারের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং আত্মত্যাগের যে মনোভাব তখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ী রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেখানো প্রয়োজন ছিল, তা দেখাতে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে সব সময়ই ছিল প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পর মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুজিবনগর সরকার নিয়ে অসন্তষ্ট ছিল তারা বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পায় এবং এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করতেও সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের মতো পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দূরত্ব তৈরিতে সফল হয় সেই পরিচিত চক্র।
মওলানা ভাসানী এবং নবগঠিত জাসদ নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। জাসদের মিলিট্যান্ট অঙ্গ সংগঠন গণবাহিনী এবং সিরাজ সিকদার-হক-তোয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন প্রমুখের নেতৃত্বে পরিচালিত উগ্র বামপন্থী গোপন সশস্ত্র সংগঠনগুলো-  যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল-  দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা ও অস্ত্র লুট, পাটের গুদামে অগ্নিকাণ্ড, ব্যাংক লুট, আওয়ামী লীগের ৫-৬ জন সংসদ সদস্যসহ জেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতাকে গুলি করে হত্যা করাসহ নানা অন্তর্ঘাত চলতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সরকারকে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়, গ্রহণ করতে হয় কিছু নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা। বন্যায় ফসলহানি, প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রমূলক ‘খাদ্য রাজনীতি’র কারণে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মৃতুø হয় কয়েক হাজার মানুষের।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে গঠন করেন জাতীয় দল-  বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল। চারটি মাত্র সংবাদপত্র রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন ব্যবস্থা চালু করায় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ দিনের যে উজ্জ্বল ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা ্লান হয়। সব মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে একটি ‘ভোলাটাইল’ অবস্থা তৈরি হয় এবং পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন বিপথগামী কিছু সেনাসদস্যদের হাতে। অবশ্য মাত্র কয়েকজন অপরিণামদর্শী, মাথা গরম সামরিক অফিসার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলেন বলে মনে করলে ভুল করা হবে। হত্যাকারীদের পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী শক্তিগুলোর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমর্থন ও সহযোগিতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী দেশপ্রেমিক অভিজ্ঞ নেতাদের বাঁচিয়ে রেখে ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে না, এই অনুভব থেকে জেলখানায় হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং এম· মনসুর আলীকে।
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে, বন্দুকের জোরে, বেআইনি সরকার প্রতিষ্ঠা করে, দেশকে সামরিক আইনের আওতায় নিয়ে এসে, সামরিক ফরমান দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারাসম্পন্ন পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য বদল করে পাকিস্তানি রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন করা হয়। শুরুতে শিখণ্ডি হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে পরিচিত খোন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রাখা হয়েছিল মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এরপর ক্ষমতা গ্রহণ করে জিয়াউর রহমান প্রথমে যে কাজটি করলেন তা হচ্ছে দালাল আইনে সাড়ে সাত শ’র মতো অপরাধীর সাজা হয়েছিল তাদের মুক্ত করে দেওয়া। একই সঙ্গে তিনি দালাল আইনটিও বাতিল করে দেন। ১৯৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়া সংবিধান থেকে তা তুলে দিয়ে জামায়াত-মুসলিম লীগের মতো স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোকে রাজনীতি করার লাইসেন্স দিলেন। সংবিধানের মূল চালিকাশক্তি এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে দিলেন।
জেনারেল জিয়া একাত্তরের স্বীকৃত রাজাকার শাহ আজিজ, আবদুল আলীম, মাওলানা মান্নানকে বানালেন মন্ত্রী। ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেন। একাত্তরে পাকিস্তান  সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু বাঙালি সেনা অফিসার ছিল, যারা পাকিস্তানের হয়ে বাঙালি নিধনে শামিল হয়েছিল। এদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে বদলি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যায় এবং পরে প্রত্যার্পিত হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসে। বেশ কয়েকজন ১৬ ডিসেম্বরের পর এদেশে যুদ্ধবন্দী হয়ে পড়ে। এদের কাউকেই বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে আর ফেরত নেননি। বঙ্গবন্ধুর মৃতুøর পর এ রকম চৌদ্দজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে জিয়া পুলিশ বাহিনীতে আত্মীকরণ করেন।
পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় ও সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করলো পূর্ণোদ্যমে। জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবিধানকে পাকিস্তানের চেয়েও বেশি ধর্মীয়করণ করে দেশের রাজনীতিতে বিভেদের ধারাকে পোক্ত করেছেন। তার মৃতুøর পর আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন একই লক্ষ্যে-  আর সেটা হলো নিজের গণভিত্তি বাড়ানো এবং সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে দেশটাকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে এগিয়ে দিলেন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার বিষয় হলো, রাষ্ট্রধর্ম করেও কিন্তু এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলেন না। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, রাষ্ট্রধর্ম করে এরশাদের গণভিত্তি পোক্ত হয়নি, জনপ্রিয়তা বাড়েনি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সাথে সাথে এরশাদ রাজনীতিতে পীরতন্ত্রকেও উৎসাহিত করেছেন। তিনি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবহার করে বিভিন্ন পীরের দরবারে গিয়েছেন এবং এসব পীরের উপদেশ প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করতেন।
এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী কৌশল হিসেবে নগ্নভাবে ধর্ম ও ভারতবিরোধিতাকে কাজে লাগালো। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার এমনই নোংরা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলো যে, ‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম চলে যাবে, মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে, দেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে’-  ইত্যাদি অপপ্রচার জোরেশোরে চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগকে ওই নির্বাচনে হারানোর জন্য দেশের বাইরে থেকেও যে ষড়যন্ত্র ছিল, সে তথ্যও এখন নানাভাবে পাওয়া যাচ্ছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, নানা ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তারা সফল হয়েছিল, নির্বাচনে জিতেছিল। যদিও ’৯১-এর নির্বাচনেও ভোট বেশি পেয়েছিল আওয়ামী লীগ কিন্তু আসন বেশি পেয়েছিল বিএনপি। ক্ষমতাসীন হয়েও বিএনপি রাজনীতিতে-রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানে-  ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছিল। সামাজিক পরিমণ্ডলে ধর্মের ব্যবহার এতটাই তীব্র হয়ে উঠলো যে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার অধিকারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগও ধর্মের বিষয়টিকে স্পর্শকাতর বিবেচনা করে নমনীয় ও আপসমূলক নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হলো। ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় এবং বিরোধী প্রচারণার জবাবে-  তাদের রাজনৈতিক আচার-আচরণেও ধর্মীয় রীতি-নীতি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেল। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধারার রাজনীতি ধর্মভিত্তিক ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কাছে কিছুটা যেন আত্মসমর্পণ করলো।

জিয়ার আনুকূল্য ধন্য স্বাধীনতাবিরোধী চক্র
বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় রাজনীতিকে সামাজিক ভিত্তি দিয়েছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তার হাত ধরেই জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে। জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী ছিল। মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করার জন্য রাজাকার-আলবদর-আলসামশ বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করেছিল। বাংলাদেশের পথঘাট ও মুক্তিকামী জনতার বাড়িঘর চেনাতে পাক-হানাদার বাহিনীর গাইড হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ৩০ লাখ বাঙালি নিধনে, এক কোটির ওপর দেশছাড়া আরও কয়েক কোটিকে ঘরবাড়িছাড়া, তিন লাখ নারীকে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন, কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুন্ঠন ও হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালানো-পোড়ানোতে যারা পাকবাহিনীর চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। গত ৫ অক্টোবর ২০১১ পাকিস্তানের ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ‘ডেইলি টাইমস’-এর সম্পাদকীয়    মন্তব্যে উল্লিখিত বিষয়গুলোকে কবুল করে নিয়ে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তান  সেনাবাহিনী যতটা না হিংস্র ছিল, ওই উগ্র গোষ্ঠীটি গণহত্যায় তাদের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে দলের নেতারা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগকারী যুদ্ধাপরাধীরা সাধারণ ক্ষমার আওতা বহির্ভূত ছিল। প্রায় ১১ হাজার দালাল-রাজাকার এসব গুরুতর অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করে। ফলে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী জেল থেকে বেরিয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইসলামী জলসায় ্লোগান ওঠে, ‘তাওয়াব ভাই-তাওয়াব ভাই, চাঁদতারা মার্কা পতাকা চাই’ (ইত্তেফাক, ৮ মার্চ ১৯৭৬)। সে দিনের উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তাওয়াবের বদান্যতায় ওই জলসায় জামায়াত-আলবদর-রাজাকারদের ছিল স্বাধীনতার পর প্রথম প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশ। ওই মজলিসে যে দাবিগুলো উত্থাপন করা হয় তার মধ্যে ছিল-  দেশের পতাকা বদলাতে হবে, নতুন জাতীয় সংগীত চাই, দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে হবে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার ভেঙে দিতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত রাজাকারদের স্মরণে মিনার নির্মাণ করতে হবে। ধৃষ্টতা আর কাকে বলে! কিন্তু যারা এই ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান কোনো ব্যবস্থা নেননি, কোনো কথা বলেননি। উল্টো যেন এদের আবদারের সমর্থনেই জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছাঁটাই করেন। ধর্মের নামে দল গঠনের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। জামায়াতে ইসলামীর মতো স্বাধীনতাবিরোধী ধর্ম ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার অস্বীকার করেন।
এখানেই শেষ নয়। জিয়াউর রহমান সেনা বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বে থেকেই সেনা ছাউনিতে বসে জন্ম দেন বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সুবিধাবাদী লোকরা ওই দলে যোগ দিতে থাকে। যে দলটির মোকাবিলায় বিএনপির আত্মপ্রকাশ, সেই নেতৃত্বশূন্য মাথাকাটা আওয়ামী লীগের তখন ঘোর অমানিশা। সে দলের সুযোগসন্ধানী দু’চারজন আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অর্থ ও পদের লোভে বিএনপিতে ঢুকে পড়ে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের আদর্শবিরোধী অবস্থান। আওয়ামী লীগের আদর্শ মানে যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর আদর্শ, এটা বুঝেই বিএনপি তার বিপরীতে অবস্থান নেয়। অর্থাৎ আকস্মিকভাবে নয়, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে শুরুতেই অবস্থান নেয় এবং এখনো বিএনপি সেই রাজনীতিই করছে। 
বিশ্বাসঘাতক খোন্দকার মোশতাকের জারি করা করা ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’কে আইনে পরিণত করেন জিয়াউর রহমান। ওই আইনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীতে পাকিস্তানি ভূতেরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে জঙ্গিবাদের উত্থানের পথ পরিষ্ড়্গার করে। গোলাম আযমের মতো কুখ্যাত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গণশত্রু ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশে আনা হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত অবৈধ নির্বাচনকে এক ব্যক্তি কমিশনের প্রধান হিসেবে বৈধ বলে রায় দেন যে বিচারক, সেই বিচারপতি সাত্তারকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। বসানো হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী খাঁটি মুসলিম লীগাররা বিএনপিতে ঠাঁই পেয়ে যান। শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে রোখার জন্য ‘বাংলাদেশি’ নামক একটি নতুন জাতীয়তার তত্ত্ব তুলে ধরেন। যার কোনো ইতিহাস নেই, ঐতিহ্য নেই, নেই কোনো যৌক্তিক ভিত্তি। নাগরিকত্ব ও জাতীয়তাকে এক মনে করে তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ও জাতির পিতা স্বীকার না করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক ও প্রধান নায়ক বানানোর অপচেষ্টা শুরু হয়।
বিএনপি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সুচতুরভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করে আসছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন খালেদা জিয়ার সরকার দেশের বরেণ্য ২৪ বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে। পরবর্তীসময়ে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নিজামী, মুজাহিদ ও আবদুল আলীমকে মন্ত্রী করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে উপদেষ্টা করা হয়। আজ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, তখন এই বিচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। মুখোশের আড়ালে বিএনপির প্রকৃত মুখটা দেশবাসী দেখতে পারছে।


ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও বিএনপি 
বিএনপির রাজনীতির প্রাণ-ভোমরা হলো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানঘেঁষা সাম্প্রদায়িক সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রধান ছাতা হিসেবে বিএনপি সব সময়ই অন্যদের ছায়া যুগিয়েছে। এমনকি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার হাত দিয়ে এদেশে সৎ ত্যাগী মানুষদের রাজনীতি করার, রাজনীতির মঞ্চ থেকে শাসন ক্ষমতায় আসার যে সংস্ড়্গৃতি- তারও মূলোচ্ছেদ করা হয়েছে। ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ধুয়া তুলে দেশের রাজনীতিকে সন্ত্রাস ও কালো টাকার ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের নীলনকশা অনুযায়ী প্রকৃত ও সৎ রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি ডিফিকাল্ট (তার উক্তি-  ও রিষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরপং ফরভভরপঁষঃ ভড়ৎ ঢ়ড়ষরঃরপরধহং) করে তোলা হয়। জেনারেল জিয়া সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে অর্থ ছড়িয়ে, ভয় ও লোভ দেখিয়ে অসৎ লোকদের এনে রাজনীতিতে জড়ো করে, তাদের দিয়ে দল গঠন করে, প্রকৃত রাজনীতিকদের রাজনীতির মাঠ থেকে হটিয়ে দিয়ে যে বিষবৃক্ষের চারা দেশের রাজনীতিতে রোপণ করেছিলেন, সেই চারাই আজ বড়ো হয়ে উঠেছে। দেশে পঁুজির অবাধ বিকাশের নামে ব্যাংকের দরোজা খুলে দেওয়া হয়েছিল নব্য ব্যবসায়ী লুটেরাদের জন্য, অনুগ্রহভোগীদের জন্য। রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। তাতে দেশে প্রকৃত শিল্পপতি, পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে লুটেরা শ্রেণী এবং লুটপাট ও বিদেশে টাকা পাচারের প্রবল ক্ষমতাশালী একটার পর একটা সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটগুলোর স্বার্থরক্ষা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবেই গড়ে তোলা হয়েছিল সমাজব্যবস্থার সর্বস্তরে এমনকি শিক্ষাঙ্গনেও শক্তিশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দেশের গণতান্ত্রিক ধারার যে সব দল ও সংগঠন রয়েছে সেই দেশপ্রেমিক শক্তি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সম্্‌ভাব্য সব কিছুই করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যাতে পুনরায় সংগঠিত হতে না পারে তার জন্য জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে সব ধরনের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগকে ভেঙে আলাদা দল গঠনেরও অপচেষ্টা করা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের দক্ষিণঘেঁষা প্রবীণ কিন্তু কিছুটা দুর্বল চিত্তের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দিয়ে পৃথক আওয়ামী লীগ গঠনের কথা উল্লেখ করা যায়। আওয়ামী লীগের মধ্যে ডান-বামের দ্বন্দ্ব সব সময় ছিল। ডান পন্থার প্রতি যাদের ঝোঁক ছিল তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে সামরিক শাসকরা। অন্যদিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী লুটেরা গোষ্ঠীকে-  যারা দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের ধারাকে ব্যাহত করার জন্য সব ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু সময়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পরীক্ষিত বামপন্থীদের মধ্যেও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) জিয়াউর রহমানের ১৯-দফা কর্মসূচি ছেপে বিলি করেছে আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) গেছে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রে মাটি কাটতে। অবশ্য তাদের ভ্রান্তি দূর হতে বেশি সময় লাগেনি।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলা হলে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব তা অস্বীকার করেন। কিন্তু হত্যা-কুøয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদল ও স্থায়ী করার প্রক্রিয়ায়ই যে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির জন্ম সেটা অস্বীকার করা হবে কোন্‌ যুক্তি ও তথ্যের ওপর নির্ভর করে? আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে অনেকেই ঘাতকদের সঙ্গে জিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। হত্যা পরিকল্পনার কথা যে জিয়াউর রহমান জানতেন এবং তিনি যে তাদের এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, তারও অনেক তথ্য-প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে। ঘাতকদের কেউ কেউ বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের কাছেও এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, জিয়া হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি। তিনি যদি ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত না থাকতেন তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েও কেন খুনিদের বিচারের সম্মুখীন না করে উল্টো তাদের বিচার থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্ড়্গৃত করেছিলেন? জিয়া নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করলেও শাসনক্ষমতা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ঠেলে দিয়েছেন। জিয়ার উত্তরসূরী হিসেবে খালেদা জিয়া তার দেখানো পথেই হেঁটেছেন। অনেক নাশকতা-সহিংসতার সঙ্গেই বিএনপির সংশ্লিষ্টতার কথা বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে। অথচ দুর্ভাগ্য, দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে বিএনপি এখনও একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল!

ছিয়াশির নির্বাচন ও বেগম খালেদা জিয়ার রহস্যময় আচরণ
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যার পর নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত সামরিক শাসক জিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার আগেই তিনি উচ্চাভিলাষী সামরিক সহকর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। হত্যা-কুø ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি নতুন পথ ধরে এগুতে থাকে। এর আগেই অবশ্য আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা থেকে দলের সভানেত্রী নির্বাচন করা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রবাসী কন্যা শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করায় ষড়যন্ত্রের রাজনীতির যারা বিশারদ তারা এটা বুঝতে পারে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হবে এবং দেশে মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতি শক্তি সঞ্চার করবে। পঁচাত্তর ও একাত্তরের ঘাতকদের সুদিন থাকবে না। বিপদ আঁচ করে তারা নতুন ছক কেটে, নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। জিয়ার মৃতুøর পর কিছুদিন বিচারপতি সাত্তার বিএনপির এক নড়বড়ে সরকার পরিচালনা করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। এরশাদের ক্ষমতা দখল এবং খালেদা জিয়াকে বিএনপির প্রধান বানানো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিরই পরিকল্পিত ছক।
মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশের রাজনীতি যাতে ফিরতে না পারে অর্থাৎ পাকিস্তানি ধারার রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন এরশাদ। দেশের মানুষ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ সমর্থন করেনি বলে শুরু থেকেই এরশাদকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। ’৮৩-র মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এরশাদকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানায়। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য ড· কামাল হোসেনের বাসায় বৈঠকরত ৩৪ জন জাতীয় নেতাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখানো হয়। নিপীড়ন চালালে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধবে না বলে এরশাদ ভুল হিসাব করেছিলেন। দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল সবাই এরশাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রাজপথে নামে। গড়ে ওঠে প্রবল আন্দোলন। এই আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে চাপের মুখে এরশাদ ১৯৮৬ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। এই নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে সেই সময়ে ১৫ ও ৭ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিসহ কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল এরশাদের ষড়যন্ত্রকেই সফল হতে সহায়তা করে। কেননা এরশাদ চাইছিলেন যে-কোনো মূল্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ভাঙ্গতে। তার বিশ্বাস ছিল, বিভক্ত রাজনৈতিক শক্তি তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। বাস্তবক্ষেত্রে ঘটলোও তাই। বিএনপি যতটা না এরশাদের স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তার চেয়ে বেশি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের চরিত্র হননে তৎপর হয়ে ওঠে। বিএনপি নেত্রীর এই আকস্মিক পিছটান সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এর পুরো ফায়দা তোলেন এরশাদ। ঐক্য বিনষ্ট হওয়ায় এরশাদের বিরুদ্ধে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে নানা কারসাজি করে প্রশাসন, কালো টাকা, মিডিয়া কুøর মাধ্যমে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করে। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি যদি ১৫ দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে ’৮৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতো, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো।
ছিয়াশির নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কেন শেষ মুহূর্তে পিঠটান দিয়েছিলেন তা সাধারণ মানুষের কাছে এক অপার বিস্ময়। তবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের রাজনৈতিক সংকটের মুখে নিক্ষেপ করে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কলঙ্ক আরোপের মাধ্যমে নিজের আপোসহীন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বেগম খালেদা জিয়া সেদিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী-  যারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে নিতে চায় না-  তারাও কলকাঠি নেড়েছে বলে মনে করার কারণ আছে। বেগম জিয়াকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই জিয়া-হত্যাকাণ্ডের পর তাকে ক্যান্টনমেন্ট ও গুলশানের বাড়িসহ নানা ধরনের ‘ভেট’ দেওয়া হয়েছিল। বেগম জিয়া সেগুলো সানন্দচিত্তে গ্রহণ করেছেন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আপোসহীনতার সিলমোহর লাগালেও এরশাদের দয়ার দান তিনি ফিরিয়ে দেননি। এমনকি অনেক পরেও তা ফিরিয়ে দিতে ওজর-আপত্তি ও টালবাহান করেছেন।   
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভূমিকা ছিল খুবই রহস্যজনক। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের এক ধরনের বেনিফিশিয়ারি হয়ে ক্যান্টনমেন্টেই বাড়িঘরের মালিকানা পেয়েছেন এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাস করেছেন। যে এরশাদ বন্দুকের জোরে বিএনপি সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করেছেন বেগম জিয়া তার কাছ থেকেই নানা সরকারি অনুগ্রহ গ্রহণ ও ভোগ করেছেন। বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে যখন জেনারেল এরশাদ সামরিক অভুøত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে হটান এবং বিএনপির অনেক নেতা ও মন্ত্রীকে জেলে ঢোকান, তখন বেগম জিয়া তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করেননি। বরং সম্পূর্ণ মৌন থেকে এরশাদের অপকর্মকে একটা সময় পর্যন্ত নীরব অনুমোদন দিয়েছেন বলা চলে।
আসলে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কুশিলবরা নেপথ্যে থেকে বেগম জিয়াকে ব্যবহার করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের ধারা যাতে বলবান হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না পারে সেজন্য সামরিক ষড়যন্ত্রকারীদের বেসামরিক লেবাসে একটি দলের প্রয়োজন ছিল। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সেই দল হিসেবে কাজ করেছে। বেগম জিয়ার নিজের কোনো আদর্শিক রাজনৈতিক অবস্থান নেই, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য তাকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সুখ-সাচ্ছন্দ ও বিলাসী জীবনের নিশ্চয়তার বিনিময়ে তিনি রাজনীতির মঞ্চে অভিনয় করে যাচ্ছেন। বলা যায়, এই ক্ষেত্রে তিনি সফল।

যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে বেগম জিয়া ও বিএনপির ভূমিকা
১৯৯১ সালে নানা কারসাজি করে নির্বাচনে জিতে বিএনপির পক্ষ থেকে আস্ফালন করে বলা হয়েছিল, একশ’ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। কিন্তু পঁচাত্তরের বিয়োগান্ত ঘটনার ২১ বছরের মাথায় এসে ১৯৯৬ সালেই আওয়ামী লীগবিরোধী তথা মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতির বিরোধী শক্তি একটা বড় হোঁচট খায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। কাজটা অবশ্যই খুব সহজ ছিল না। তারপরও আওয়ামী লীগ সরকার তখন অত্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আত্মস্বীকৃত খুনিদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে ফাঁসিতে ঝোলানোর পথে না গিয়ে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা পূরণ করতে কিছু মানুষকে যেনতেনভাবে মৃতুøদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু জেনারেল জিয়ার মৃতুøর পর সামরিক আদালতে তড়িঘড়ি করে ১৪ জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
দুঃখের বিষয় দেশের প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়া এতই লম্বা যে, পাঁচ বছরের মেয়াদকালে শেখ হাসিনার সরকার তা সম্পন্ন করতে পারেনি। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃতুøদণ্ডের আদেশ দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃতুøদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃতুøদণ্ড বহাল রেখে ৩ জনকে খালাস দেন। এরপর সরকার বদলের পর এই প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ওই সময় ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা হয়তো মনে করেছিলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল আবার ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হবে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শেষ করতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়নি। একদিকে আওয়ামী লীগ বিরোধী সর্বাত্মক অপপ্রচার, অন্যদিকে বাস্তবতা অনুধাবন করে কার্যকর কৌশল গ্রহণে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্রের নীলনকশার নির্বাচনে এককদল হিসেবে বেশি ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ আসন সংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় বসে তাদের ‘আদর্শ’ মতোই বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। হত্যা মামলার আপিল শুনানি নিয়ে জোট সরকার ক্রমাগত টালবাহানা করেছে। জোট সরকারের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ নেপথ্য থেকে কলকাঠি নাড়ায় একের পর এক বিচারপতি ওই মামলার শুনানি গ্রহণে বিব্রতবোধ করেছেন। এছাড়াও আপিল বিভাগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ না দিয়ে মামলাকে হিমঘরে পাঠানো হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যে ওই মামলা শেষ করতে চায়নি, খুনিদের বিচারের মুখোমুখি হওয়াটা যে জোট সরকারের মনঃপূত ছিল না, এটা কারও না বোঝার কথা নয়। সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি বিএনপি-জামায়াত কৃতজ্ঞ এবং দুর্বল। এই খুনিচক্রের বদৌলতেই যে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির উত্থান।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগ্রহ বা প্রচেষ্টা বিএনপির মধ্যে কখনোই ছিল না। সে জন্যই নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী নেতৃত্বকে দুর্বল বা খতম করার প্রক্রিয়ায় তাদের অধিক মনোযোগ লক্ষ করা যায়। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামীগের সব শীর্ষনেতাকে হত্যার অপচেষ্টার সঙ্গেও বিএনপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে হত্যার যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, এখন নানাভাবেই এটা জানা যাচ্ছে, ওই ঘটনায় বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও জড়িত ছিলেন। আক্রমণকারীদের রক্ষা করার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানা অপতৎপরতা চালিয়েছে। ওই গ্রেনেড হামলার দায়ও আওয়ামী লীগের ওপরই চাপিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন বেগম জিয়া থেকে শুরু করে বিএনপির শীর্ষ নেতারা। শুধু শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনাই নয়, ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার, আহসান উল্লাহ মাস্টার, শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার দায় বিএনপি সব সময়ই আওয়ামী লীগের ওপর চাপাতে চেয়েছে। এসব ঘটনাসম্পর্কিত মামলাগুলোকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে, আওয়ামী লীগকে ফাঁসাতে নানা অসৎ ফন্দিফিকির করেছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের বিপুল বিজয় স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা এটাকে সহজভাবে মেনে নিতেও পারেনি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচনে বিএনপি কোনো সময় হারতে পারে না। বিএনপি সব সময় থাকবে শাসক দলের মুকুট পরে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করায় বিএনপি নেতৃত্ব চরম অস্বস্তিতে আছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য তাদের নেই। এর মধ্যেই তারা সরকার পতনের লক্ষ্যে বিভিন্ন হিংসাত্মক কর্মসূচি পালন করছে। জামায়াতসহ বিভিন্ন উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কর্মীদের দিয়ে নাশকতামূলক কর্মসূচি পালন করছে। বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার পক্ষে উস্ড়্গানি দিচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপি শুরুর দিকে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিলেও সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রকাশ্যেই নিজামী-মুজাহিদদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং কার্যত তিনি বিচারেরও বিরোধিতা করেছেন। সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটা বলা হয়ে থাকে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ বানচাল করাই বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। প্রথমে মানুষ এটা সেভাবে বিশ্বাস না করলেও এখন বিভিন্ন সমাবেশে বেগম জিয়ার প্রকাশ্য বক্তব্যের পর মানুষের কাছে তার অবস্থান ও মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপি এখন মূলত জামায়াতনির্ভর দলে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াত জোটের রোডমার্চ উপলক্ষে আয়োজিত সিলেট, বগুড়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন সমাবেশে জামায়াতের শক্তি প্রদর্শন সেটাই প্রমাণ করে। বিএনপিতে যারা নিজেদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে দাবি করেন, তারা কি বেগম জিয়ার এই দাবির সঙ্গে একমত যে, নিজামী-মুজাহিদরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী নয়? গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদরা একাত্তরে কোন্‌ পক্ষ অবলম্বন করে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে কাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল? বেগম জিয়া ও পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা একাত্তরের স্মৃতি ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু স্বজনহারা কোটি কোটি বাঙালির পক্ষে কি তা ভুলে যাওয়া বা ভুলে থাকা সম্্‌ভব?

গণতন্ত্র ও প্রগতিবিরোধী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে বিএনপি কেবল সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে বলে মনে করলে ভুল করা হবে। বিএনপি বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচুøত করতে চায়। কারণ, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদেরও বাঁচানো সম্্‌ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং সরকার কি বিএনপির এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করবে, নাকি এটাকে মামুলি বিষয় বলে উপেক্ষা করবে?
বিএনপির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করার কোনো বিকল্প বর্তমান সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। এটা শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন নয়, দেশে নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি চালু রাখার স্বার্থেই করতে হবে। আর তা না হলে শুধু আওয়ামী লীগেরই পরাজয় হবে না, পরাজয় ঘটবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের, সকল শুভ শক্তির।
মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার এই চার দশকে দুটি প্রধান ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি পাকিস্তানি আমলের রাজনৈতিক ধারা, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সিভিল মিলিটারি বুøরোক্রেসি, নব্যধনী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি গণবিরোধী চক্র গড়ে ওঠে। এই চক্রের পেছনে শক্তি জোগায় সৌদি পেট্রো ডলার, পাকিস্তানি সামরিক চক্র এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এই শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের বহু ভুলত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একটি শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে আওয়ামী লীগ ও বামধারার কয়েকটি দল অর্থাৎ চৌদ্দদলীয় জোট। জনসমর্থনেই আওয়ামী লীগ ওই জোটের শক্তির প্রধান উৎস।       
গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কখনও চায়নি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। আওয়ামী লীগের গণসম্পৃক্ততা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্রই সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দলটির প্রতি বিমুখ করে রেখেছে। এমনকি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা ঠেকানোর জন্য তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিএনপি-জাতীয় পার্টির জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতার শত্রুদের ক্ষমতায় এনেছে। স্বাধীনতার আদর্শ ও চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পাহারায় তারা দেশে একটি নব্যধনী শ্রেণী ও শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কালো টাকাকে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিয়েছে। এসব কাজে তারা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগীয় মৌলবাদ ও পশ্চিমা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ও সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস বিশ্ব ব্যাংক আইএমএফ, ন্যাটো ও সিআইএ-র পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ কখনও একটি বামপন্থী বা সোশ্যালিস্ট দল ছিল না, ছিল একটি মাল্টিক্লাস লেফ্‌ট অফ সেন্টার পার্টি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দলটি এই চরিত্র বজায় রাখতে পারেনি। এই দলেও ক্রমশঃ কায়েমি স্বার্থবাদীদের ভিড় বাড়তে থাকে। ডানপন্থার দিকে, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপসের দিকে ঝোঁক বাড়তে থাকে। কখনও কখনও সহজে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ইচ্ছা ও স্বার্থের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ আপস করেছে। কিন্তু পঞ্চাশ বছরের গণআন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী দল গণসম্পৃক্ততা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেনি। আওয়ামী লীগকে তাই ক্ষমতায় আসতে দিতে দেশের ওই চক্র, মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগীয় মৌলবাদ এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সব সময়ই অনাগ্রহ এবং আপত্তি। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা ঠেকানো এবং তাদের স্বার্থরক্ষার বাহন হিসেবে তারা বিএনপিকেই বেছে নিয়েছে।

বার বার আক্রান্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি
একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এদেশে বোমা-গ্রেনেড-হত্যা-কুø-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগসহ তার মিত্ররা। আর এসবের প্রতিকারের জন্যও তাদেরকেই এককভাবে ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলায় হত্যা করা গেলে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গ মুখে আনার জন্য মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্্‌ভব না হলে এই বিচার যেভাবে ঝুলে গিয়েছিল তা হয় ঝুলে থাকতো কিংবা কোনো কারসাজিতে খুনিদের অব্যাহতি দেওয়া হতো। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হওয়ায় ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যার চূড়ান্ত বিচার সম্্‌ভব হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে ইনডেমনিটি বিলও বাতিল হতো না, মামলা করার পথও সুগম হতো না; বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও তার রায় ছিল সুদূরপরাহত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগের ছোটখাটো ভুলত্রুটি নিয়ে যারা অতি সোচ্চার তাদের এই রাজনৈতিক বাস্তবতাটা বিবেচনায় রাখতে হবে। না হলে ভুল পথে হাঁটা হবে।
এদেশে এখন পর্যন্ত  যত নাশকতা, বোমাবাজি, গ্রেনেড হামলা, জঙ্গি হামলা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার সব কটির শিকার হয়েছে-  আওয়ামী লীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অন্য কোনো রাজনৈতিক-সাংস্ড়্গৃতিক সংগঠন, প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিবিদ, বাঙালি সংস্ড়্গৃতির ধারক ব্যক্তি, সংস্থা বা অনুষ্ঠান। এখন পর্যন্ত  জামায়াত-বিএনপি-জাতীয় পার্টি কিংবা অন্য কোনো মৌলবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি, দল বা সংস্থা কিংবা তাদের কোনো অনুষ্ঠানে কোনো রকম হামলা-খুন, বোমা-গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি। ঢিলটা কে ছুঁড়ছে তা অনেক ক্ষেত্রে উদঘাটিত না হলেও ঢিলটা কার বা কাদের ওপর পড়ছে- তা দেখেও কিন্তু আমরা সহজেই বুঝতে পারি-  কে বা কারা টার্গেট। আর এ ক্ষেত্রে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যে ঢিলটা কারা ছঁুড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই যে মৌলবাদী ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট চক্রের মূল টার্গেট-  একথা কবুল করে নিতে বিরাট কোনো গবেষণার দরকার হয় না। বিএনপি সব হামলা, সব ষড়যন্ত্র ও নাশকতার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে, এসব ঘটনার তদন্ত ও বিচার কাজে বাধা সৃষ্টি করে অথবা মামলার তদন্ত ও বিচার কাজ ইচ্ছেমতো প্রভাবিত করে নিজেদের ষড়যন্ত্রকারীর দোসর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির প্রাণভোমরা এখন বিএনপি। আর তাদের ‘বি-টিম’ হিসেবে কাজ করা মৌলবাদী সংগঠনের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী ভাবধারাপুষ্ট একটি মৌলবাদী ধর্মরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে বর্তমানে এক ডজনেরও বেশি ধর্মাশ্রয়ী দল ও গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে এবং তারা নানা নামে ও ছদ্মবেশে নিরন্তর অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই বিএনপি ও তাদের দোসরদের অপতৎপরতা সম্পর্কে সজাগ এবং সতর্ক থাকা, তাদের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে গণমানুষের অধিকার আদায় এবং সুষ্ঠুধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করাটা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে চলা আওয়ামীবিরোধী তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণাকে অকার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার পরও আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের রাজনীতিতে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করার নিরন্তর যে প্রচারণা সেই প্রচারণায় দেশের নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়েছে। তারা মনে করেছে, ‘আওয়ামী লীগ মানে হচ্ছে, দুঃশাসন, বিভীষিকা, হত্যা-খুন-লুটপাট। ভারতের কাছে দেশকে, দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দেওয়া। ইসলামের টুটি টিপে ধরা।’ পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তিদের এই অপপ্রচার আওয়ামী লীগকে যে নানা সময়ে কোণঠাসা ও বিব্রত করে তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের অনেক মানুষই মোটামুটি এই ধারণায় বিশ্বাসী। এই অপবিশ্বাসের মূল উপড়ে ফেলার জন্য যে ধরনের মতাদর্শিক লড়াই চালানো দরকার তেমন কিছু খুব একটা চোখে পড়ে না। ক্ষমতায় গিয়েও দলের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে সুসংহত করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। প্রতিপক্ষ যেখানে প্রবল ও শক্তিশালী সেখানে যে দৃঢ়তা, সততা, নমনীয়তা ও উদারতা প্রয়োজন ছিল তা আওয়ামী লীগ দেখাতে পারেনি। এমনকি কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালনকারী ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই চালানোর তেমন ধারাবাহিক উদ্যোগ ও আন্তরিকতা চোখে পড়েনি। বড়দলসুলভ অহমিকা আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে একগুঁয়ে নীতি-পদক্ষেপ আওয়ামী লীগকে আরও বেশি একা বানিয়ে ফেলেছে। এতে করে অনেক পরীক্ষিত মিত্রও নিষ্ত্র্নিয় হয়েছেন কিংবা ভিন্ন অবস্থানে চলে গেছেন। ’৮০-র দশকে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল গঠন ও ’৯০-এর দশকে ড· কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠন আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করেছে। এরফলে ’৯১ ও ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি-র বিজয় সহজতর করেছে।    
প্রসঙ্গত আবদুর রাজ্জাক ও ড· কামাল হোসেনের কথাও উল্লেখ করা যায়। তারা দু’জনেই বঙ্গবন্ধুর স্নেহ এবং সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার দায়িত্ব আবদুর রাজ্জাককে এবং সংবিধান রচনায় ড· কামাল হোসেনের ওপর দায়িত্ব অর্পণ ছিল তাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থারই বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবদুর রাজ্জাক ও ড· কামাল হোসেন যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এতদসত্তেও  ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনা ড· কামালকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করেছিলেন। এরশাদের পতনের পর ড· কামাল হোসেন আর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ড· কামাল হোসেনের রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকাও গঠনমূলক এবং ইতিবাচক ছিল না। সব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করাই যেন তার প্রধান রাজনীতি হয়ে দাঁড়ায়। ড· কামালের এই ভূমিকা অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন হয়েও এখন যে রাজনীতি করছেন তাতে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের ক্ষতি বৈ লাভ কিছু হচ্ছে না। তাছাড়া তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়নক হয়েই আওয়ামী লীগের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গণফোরাম গঠন করেছিলেন এটা এখন নানাভাবে জানা যাচ্ছে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭১ সনে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরকে মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী কালপর্বে একটি প্রচারণা ছিল, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে হলে আর্মি ও আমেরিকা কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এই প্রচারণা আওয়ামী লীগের ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের প্রভাবিত করাটাই স্বাভাবিক। আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্্‌ভাবনা মাথায় রেখে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে তথা রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে বাদ দেয়ার নানা কূটচাল চেলে এসেছে। এই চক্রই সম্্‌ভবত ড· কামাল হোসেনকে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে এবং কামাল হোসেনও নিজেকে ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে যোগ্য বিবেচনা করে গণফোরাম গঠন করেছিলেন। গণফোরামের সূচনাটা এতটাই ঢাকঢোল পিটিয়ে হয়েছিল যে, দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীদেরও অনেকে সেই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। প্রধান অতিথির ভাষণে ড· মুহম্মদ ইউসূস স্বপ্নের পার্টির কথা বলেছিলেন। তা থেকে কারো কারো মনে হয়েছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিয়ে ড· কামালের নেতৃত্বে গণফোরামই বুঝি পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন দল হতে যাচ্ছে। গণফোরামে যোগদানকারী সিপিবি সভাপতি সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক তার অনুসারী-সমর্থকদের প্রকাশ্যেই বলতেন যে, ‘আর বি-টিমের রাজনীতি নয়, এখন এ-টিমেই খেলবো।’ অর্থাৎ তাকে হয়তো সে রকম নিশ্চয়তাই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হয়নি। গণফোরাম দেশের রাজনীতির এ-টিম হতে পারেনি। সে জন্যই কি আওয়ামী লীগকে বিব্রত করা ও অস্বস্তির অবস্থায় ফেলার লক্ষ্য নিয়ে ড· কামাল হোসেন কাজ করছেন? এক-এগারোর পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ড· ইউনূসও কিছু সময় নতুন দল গঠন করে ক্ষমতার রাজনীতিতে অংশীদার হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ ছাড়ার পর থেকে ড· কামাল হোসেন যে ভূমিকা পালন করেছেন তাতে আওয়ামী লীগবিরোধীরাই লাভবান হয়েছে, উৎসাহিত হয়েছে। তবে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার যে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল সেখানেও ড· ইউনূস ও ড· কামাল হোসেন উদ্যোগী ভূমিকায় মাঠে নেমেছিলেন। তখন দলে সংস্ড়্গারের প্রস্তাব উত্থাপন করে আওয়ামী লীগের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাও শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হন। পরবর্তীসময়ে তারা শেখ হাসিনার আনুগত্য মেনে নিলেও তার মন পাননি। তারা এখনও দলের মধ্যে অনাহুত। শেখ হাসিনা যদি দলের পরীক্ষিত নেতাদের ক্ষণিকের বিভ্রান্তি ও ভুলবোঝাবুঝির সীমা অতিক্রম করে সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন, তাহলে হয়তো তাকে সর্বগ্রাসী অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতার বিরুদ্ধে একাই লড়াই করতে হতো না।

উদ্যোগী হতে হবে আওয়ামী লীগকেই
১৯৭০-এর নির্বাচনের পর ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ আবার গণমানুষের যুগান্তকারী সমর্থন পেয়েছে। ২০০৮-এর বিজয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির অনুকূলে যাওয়ায় একটি সুস্থ রাজনীতির পথে ফেরার সম্্‌ভাবনা জাগিয়েছিল। সে রকম একটি সদিচ্ছায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিরীক্ষাধর্মী মন্ত্রিসভা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকজনের মৃতুøদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বিদেশে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষা, কৃষি, বিদ্যুৎ, খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত খাতগুলোতে লক্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের আশ্রয়ে জঙ্গিবাদের যে থাবা বিক্ষত করেছিল বাংলাদেশকে, বিগত তিন বছরে তার মূলোৎপাটন অনেকটাই করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু সরকার পরিচালনায় লক্ষণীয় গতি সৃষ্টি করে গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি সরকারের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করলেও তাদের এই দুবৃêত্তপনা থামানোর ব্যাপারে কোনো সক্রিয় উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সরকার পরিচালনা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক ধরনের অদূরদর্শিতা লক্ষ করা যায়। মন্ত্রিসভার অদক্ষতার কারণে সরকারের অর্জনগুলো মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়নি। এই বাস্তবতার মূল্যায়ন যথাসময়ে না করায় ঘুরে দাঁড়ানোর যে সুযোগ ছিল তা অবহেলায় নষ্ট করা হয়েছে। তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর পড়ন্ত বিকেলে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় সামান্য  রদবদল ও সংযোজন ঘটিয়েছেন। যদিও এটা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। প্রয়োজন যখন শল্য চিকিৎসার তখন সামান্য যোগ-বিয়োগ করে আরোগ্য লাভ করা যাবে না বলেই অনেকে মনে করছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের অনেকে সুপার মিনিস্টার বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। ‘অফারংবৎং ংযড়ঁষফ হবরঃযবৎ নব ংববহ হড়ৎ যবধৎফ, বীপবঢ়ঃ নুঃযব ড়হব যিড়সঃযবু ংযড়ঁষফ নব ধফারংরহম·’ এই আপ্তবাক্য উপদেষ্টাদের মেনে চলা উচিত।
এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, বর্তমানে দেশের মানুষ এক দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। হামলা-নাশকতা, হত্যা-খুন, বিডিআর ও সেনা সদস্যদের দিয়ে বিদ্রোহ ঘটানো সব ধরনের অপতৎপরতার সঙ্গেই প্রধান বিরোধী দলের জড়িত থাকার কথা শোনা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সংগঠনকে একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে এবং নিজ দলে সুস্থ রাজনীতি চর্চা বাড়াতে না পারে তবে প্রবল ও শক্তিশালী ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়বে। মানুষ চায় না আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল রাজনীতির পরাজয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুনরুত্থান ঘটুক। এবার যদি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় থাকতেও মুক্তিযুদ্ধের ধারায় রাজনীতির পরাজয় হয়, তাহলে দেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল ধারা প্রবল হয়ে উঠবে। গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক চিন্তার অধিকারী মানুষের বাস-অযোগ্য হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। আওয়ামী লীগের কিছু ত্রুটি-দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ধারার পক্ষে তাদের অবস্থান এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারকে অস্বীকার করা যাবে না। আওয়ামী লীগ আর যাই করুক, হত্যা-কুø-জঙ্গিবাদী-হঠকারী রাজনীতি করে না। আর পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা যেখানেই আশ্রয় পাক অন্তত আওয়ামী লীগে তাদের ঠাঁই হবে না। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে প্রগতিশীল ধারার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্্‌ভব বলে মনে হয় না। জঙ্গিবাদী-সুবিধাবাদী রাজাকারি চেতনাকে কবর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আওয়ামী লীগকে এড়িয়ে নয়, আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়, তাদের সঙ্গে নিয়েই চূড়ান্ত লড়াইটা করতে হবে। এজন্য কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে একাট্টা হয়ে কাজ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব দল, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়কে। আর আওয়ামী লীগের বিপদ ও বিপর্যয়ে হাত গুটিয়ে বসে থেকে নীরবে দেখে গেলে চরম মূল্য দিতে হবে সবাইকেই।
মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্ব হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ধারা বনাম পাকিস্তানি তথা মৌলবাদী-ধর্মান্ধ-জঙ্গিবাদী ধারা। প্রথম ধারাকে শক্তিশালী ও সংহত না করলে দেশ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। দেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। কাজেই সবাইকে নিয়ে চলার উদ্যোগটিও নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। জেনে বা না জেনে যারা ‘তৃতীয় শক্তি’, ‘বিকল্প শক্তি’ খোঁজার নামে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত দেশের রাজনৈতিক শক্তির বর্তমান মেরুকরণ দেখেই। সমালোচনা-আত্মসমালোচনা অবশ্যই থাকবে এবং চলবে কিন্তু সেটা যেন কোনোভাবেই পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির যারা ধারক-বাহক তাদের উৎসাহ জোগানোর নামান্তর না হয়। একাত্তরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, সেই বিজয় কেড়ে নিতে দেওয়া যাবে না কাউকে, কোনোভাবেই। আমাদেরকে আবার একাত্তরের মতো দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে জয় বাংলা বলে।
১০ মার্চ ২০১২












অৎঃরপষব ভড়ৎ ইধহমষধফবংয ঋড়ঁহফধঃরড়হ-২

বাংলাদেশের সমাজ প্রগতির ধারা : মোনায়েম সরকার

বাংলাদেশের সমাজ প্রগতির ধারা
 মোনায়েম সরকার
ভূমিকা
বাংলাদেশের তথা উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অনেকের মতে, এশিয়ায় ধর্মই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অনুপ্রেরণা ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে, ভিয়েতনাম থেকে প্যালেস্টাইন পর্যন্ত সর্বত্রই উপনিবেশিক শক্তি ও উপনিবেশবাদীয় ধর্ম ভিন্ন ছিল এবং তাই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরেসোরে হয়েছে। আর যেখানে, যেমন, ফিলিপাইনে উপনিবেশিক শক্তি আর উপনিবেশের ধর্ম একই ছিল সেখানে দ্বন্দ্ব-সঙ্কট তেমন প্রকট হয় নাই। এটা নোবেল বিজয়ী সুইডিশ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক গুনার মিরডালের অভিমত। তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘এশিয়ান ড্রামা’ যা পরবর্তীকালে ‘এশিয়ার রঙ্গমঞ্চ’ হিসেবে বাংলায় অনূদিত হয়েছে তার প্রধান উপপাদ্য। গ্রন্থটি ১৯৬৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
তারও আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় কার্ল মার্কস ঔপনিবেশিকতার প্রশংসা করেছেন। যেমন ভারতে উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এশিয়ার স্থবির সমাজে এটা প্রায় একটি সামাজিক বিপ্লব।’ মার্কস ছাড়াও অনেকে যেমন ম্যা ওয়েবার, যাকে প্রায়ই বুর্জোয়া মার্কস বলা হয়, তিনি ভারতীয় তথা এশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রাচ্যের স্বেচ্ছাচারিতা বা ‘ওরিয়েন্টাল ডেসপটইজম’ বলে উল্লেখ করেছেন। আর ভারতের ধর্মকে ‘প্রিভ্যান্ডালইজম’ অথবা ‘প্রাক-ধ্বংসাত্মকবাদিতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ধরনের আরো অনেক মতামত আছে। এমনকি ভারতের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা জওহরলাল নেহরু তার আত্মজীবনী ‘দ্যা ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইতে এক জায়গা লিখছেন, ‘এটা হয়তো অনিবার্য ছিল যে ভারত ইংরেজদের উপনিবেশ হবে, কেননা সামাজিকভাবে ইংরেজরা বেশি উন্নত ছিল।’
তবে পরবর্তীকালে অনেকেই এসব ধারণা নাকচ করে দিয়েছেন। এর ভেতর সাম্প্রতিককালে বহুল আলোচিত ও প্রভাব বিস্তার করে প্যালেস্টাইনী বংশোদ্‌ভূত মার্কিন দার্শনিক এডওয়ার্ড সাঈদের মত। তিনি ইউরোপ কেন্দ্রিক বিশ্লেষণকে ‘ওরিয়েন্টালইজম’ অথবা প্রাচ্যবাদিতা বলে সমালোচনা করেছেন। তার মতে ইউরোপের কিছু পণ্ডিত প্রাচ্য সম্বন্ধে খুব অল্প জেনে অনেক বেশি বলেছেন-  এটা ঠিক নয়। যা উচিত তা হচ্ছে প্রাচ্যের নিজস্ব পাণ্ডিত্য গড়ে তোলা।
শুধু এডওয়ার্ড সাঈদই নয়, ভারতের অনেক ইতিহাসবিদ ইউরোপের পণ্ডিতদের প্রাচ্য সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা গ্রহণ করেননি। তাদের মধ্যে ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপ্পার, ডি ডি কোসাম্বি এবং অন্যরা আছেন। তারা অনেকেই মার্কসবাদী হলেও মার্কসের ভারত সম্বন্ধে মূল্যায়নের সাথে একমত হননি। রোমিলা থাপ্পার ত’ রীতিমতো চার খণ্ডে উৎপাদন ব্যবস্থার ভিত্তিতে ভারতের ইতিহাস রচনা করে ফেলেছেন। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য এশীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছেন সিঙ্গাপুরের সৈয়দ হোসেন আল আটাস। ঔপনিবেশিকতা ভালো হোক আর মন্দ হোক এর উত্তরাধিকার নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। তাই আমাদের দেশের রাজনীতি বুঝতে খানিকটা ইউরোপীয় উপনিবেশিকতার বিবর্তন বুঝতে হবে।

উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে
উপমহাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম আর ধর্মনিরপেক্ষতা অনেক সময়ই প্রধান রাজনৈতিক ইসুøতে পরিণত হয়েছে। এক অর্থে এটা হয়তো স্বাভাবিক, কেননা এশিয়া থেকেই বেশিরভাগ ধর্মের উৎপত্তি। ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, কনফুসিয়ানবাদ, টাওবাদ, সিন্টোবাদ-  সবই এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলেই জন্ম লাভ করেছে। আরও পেছনে গেলে জোরোস্ট্রীয়ানবাদসহ (৬ষ্ঠ-৫ম খ্রিষ্টপূর্ব) আরো অনেক ধর্মীয় মতবাদ এ অঞ্চলে জন্ম নেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উর্বর হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সকল একেশ্বরবাদী ধর্মসমূহ-  ইহুদীবাদ, খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের সূতিকাগার আর ভারতে সৃষ্টি হয়েছে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম।
সেই তুলনায় ইউরোপ, আমেরিকা বা আফ্রিকায় সেরকম কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠালাভ করেনি। তারা এশিয়ার ধর্মগুলোকেই এক পর্যায়ে অনুসরণ করেছে। আফ্রিকার যেসব সনাতনি ধর্ম ছিল তা বেশিরভাগই উপনিবেশিকতার ধাক্কা সামাল দিতে পারেনি। আজকে তারা বেশিরভাগই উপনিবেশিক শক্তির ধর্ম খ্রিস্টান ধর্মই গ্রহণ করেছেন। সে যাই হোক, দক্ষিণ এশিয়ায় তুলনামূলক অল্প সময় উপনিবেশিক শক্তি থাকলেও অনেক দিক বিবেচনা করলে এর প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। হঁ্যা, তারা হয়তো মানুষজনকে ধর্মান্তরিত করেনি, অন্তত ব্যাপকভাবে; কিন্তু তারা আধুনিক শিক্ষা ও সংস্ড়্গৃতির বিকাশ ঘটায় যা মূল জনগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, ঔপনিবেশিকতার শেষ দিকে ভারত উপনিবেশ হয়। ইউরোপের প্রথম উপনিবেশিক শক্তি ছিল পর্তুগাল ও স্পেন। ভারতেও প্রথম ইউরোপীয় বণিকরা ছিলেন পর্তুগীজ-  বাংলায় যাদের হারমাদ বলা হতো। আমাদের দেশের বিভিন্ন গীর্জাগুলো তার সাক্ষ্য বহন করে। ভাসকোডা গামা যে ইউরোপ থেকে ভারতে আসার প্রথম পথ আবিষ্ড়্গার করেন তিনি নিজেও গর্তুগীজ ছিলেন। পরবর্তীকালে ভারতের পশ্চিম উপকূলে গোয়া, দ্যামান, দিউ দীর্ঘদিন পর্তুগীজ উপনিবেশ ছিল।
শ্রীলঙ্কার ইতিহাস দেখলেই বোঝা যাবে বিভিন্ন সময়ে ইউরোপীয় উপনিবেশিক শক্তির অবস্থান। দেশটি ফিলিপাইনের মতো পাঁচশ’ বছর ইউরোপীয় উপনিবেশ ছিল, তবে কোনো একটি দেশের নয়-  বিভিন্ন দেশের। প্রথম একশ’ বছর পর্তুগীজ উপনিবেশ, পরের দুইশ’ বছর ওলন্দাজ উপনিবেশ এবং শেষ দুইশ’ বছর ব্রিটিশ উপনিবেশ। এক কথায় বলা যায়, শ্রীলঙ্কার ইতিহাস উপনিবেশবাদের পরিবর্তনশীলতার একটি প্রিজম। যখন যে উপনিবেশিক শক্তি বিশ্বকে প্রভাবিত করেছে তারাই শ্রীলঙ্কাকে কব্জা করেছে।
এ কথাগুলো বলা হচ্ছে এই কারণে যে, ভারতীয় তথা দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতি বুঝতে গেলে ইউরোপীয় উপনিবেশিকতা খানিকটা হলেও বুঝতে হবে।
উপনিবেশ, ইংরেজিতে কলোনি-  হলো একটি স্প্যানিশ শব্দ-  যার শাব্দিক ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে বসতি। যেহেতু স্পেনীয়রাই প্রথম উপনিবেশিক শক্তি ছিল তাই তাদের আদি শব্দই ইংরেজিতে ঢুকে গেছে। ১৬৬৬ সালের জিব্রাল্টারের যুদ্ধে ক্যাপ্টেন নেলসনের নেতৃত্বে ইংরেজরা স্প্যানিশ আরমাডাকে পরাজিত করে এবং নিজেদের প্রধান উপনিবেশিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কলম্বাসের কথা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। যিনি আমেরিকা ‘আবিষ্ড়্গার’ করেছিলেন। তিনি নিজে ইতালীয় হলেও তিনি স্পেনের রানী ইসাবেলার জাহাজ নিয়ে আমেরিকা অভিযানে যান। তার পরের ইতিহাস-  প্রায় সমগ্র আমেরিকা লাতিন আমেরিকায় পরিণত হলো। লাতিন মানে লাতিন ভিত্তিক ভাষা যেমন স্প্যানিশ এবং পর্তুগীজ ভাষা ব্যবহারকারী। যদি ব্রাজিল পর্তুগালের উপনিবেশ না হতো তা হলে লাতিন শব্দ ব্যবহার না করে সহজেই স্প্যানিশ অ্যামরিকা বলা যেতো।
উপনিবেশিকতার প্রথম ধাক্কায় স্পেনীয়রা আমেরিকায় বসতি স্থাপন করে-  প্রয়োজনে স্থানীয় অধিবাসীদের হত্যা করে। এই কাণ্ডটি শুধু স্প্যেনীয়রা করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইংরেজ উপনিবেশেও একই কাণ্ড ঘটে। তবে ১৭৭৪ সালে যখন লর্ড কর্নোয়ালিশ পটোমাকের যুদ্ধে জর্জ ওয়াশিংটনের কাছে পরাজিত হয় তখন ইংরেজরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। অর্থাৎ কর্নোয়ালিশ যখন ভারতে অথবা তখনকার বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দায়িত্ব নিলেন, তখন তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করলেন। আদি বাসিন্দাদের না হটিয়ে বরং একটি নতুন, অনুগত শ্রেণী তৈরি করলেন। অর্থাৎ আমেরিকা থেকে তারা বুঝলেন তাদের স্বজাতি বাসিন্দারাও উপনিবেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে এক সময় বিদ্রোহ করতে পারে। তাই সেটার আর দরকার নেই।
একদিক থেকে দেখলে এটা উপনিবেশবাদের একটা নতুন অধ্যায়।
অচিরেই এই পর্যায়ে প্রয়োজন হয়ে ওঠে একটি ‘করণিক’ শ্রেণী যা উপনিবেশবাদের দার্শনিক ম্যাকুলের ভাষায় ‘মনের দিক থেকে শ্বেতাঙ্গ, আর গায়ের দিক থেকে বাদামি’। পরবর্তীকালে ইংরেজ সাহিত্যিকেরা এই শ্রেণীকে ‘ব্রাউন সাহিব’ বলে রসিকতা করেছেন।
তবে ভিন্নভাবে যারা দেখেছে তারা আবার একে বলেছে ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’। এদের মধ্যে অনেকেরই ছিল ইংরেজদের সাথে একটা ভালোবাসা-ঘৃণার সম্পর্ক। একদিকে যেমন তারা নিজেরাই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন অর্থাৎ উপনিবেশিকতার সুফলভোগী, অন্যদিকে সেই শিক্ষার ফলে তারা যে দ্বিতীয় স্তরের নাগরিক সেটাও বুঝতে পারেন।
যারা ঘৃণার পথে বেশি হাঁটলেন এবং তার বিশদ বিবরণ ইতিহাসবিদরা যথেষ্ট সংকলিত করেছেন-  তারা নিঃশেষিত হয়ে গেছেন। যদিও এটা আমাদের ভাবতে হয়তো একটু কষ্ট লাগবে। যেমন হান্টার ১৮৭১ সালে তার ‘ইন্ডিয়ান মুসলমান’ বইতে লিখছেন এরা (বাঙালি মুসলমানেরা) এতই খারাপ যে, ‘এরা তাদের মাদ্রাসাগুলোর মাধ্যমে লোক বাছাই করে সুদূর আফগানিস্তানে পাঠাচ্ছেন ব্রিটিশবিরোধী যুদ্ধ করতে’। আফগানিস্তানে অবশ্য ইংরেজরা ঠেকে গিয়েছিল। দু’দুটি ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধে বৃটিশরা আফগানদের সাথে পরাজিত হয়েছিল আর বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন ঠেকে গিয়েছিল। দু’বারই যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ হয়েছিল। তবে বাঙালিরা আফগানিস্তানে যাই করুক নিজের দেশে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করে খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। বার বার বিদ্রোহ হলো, সন্ন্যাস বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ-  বিদ্রোহের কোনো শেষ নেই। কিন্তু সব সশস্ত্র প্রচেষ্টা, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর অক্ষশক্তি পুষ্ট ভারত অভিযানসহ ব্যর্থ হলো। সফল হলো শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন। তাই তা কখনো ব্রিটিশদের উদার উপনিবেশিকতার পরিসর পার হতে পারেনি।
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার অব্যাহত পরে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল-  ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ইলবার্ট বিলও আই সি এস পরীক্ষার বয়স কমানোর প্রতিবাদে ১৮৮০-র দশকে যে তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালনার জন্য প্রাক্তন বৃটিশ অফিসার লর্ড এলেন অক্টোরিয়াস হিউম একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ঐ দলের নামই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, তার প্রথম সভাপতি উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জী। কংগ্রেসের প্রথম সম্মেলন (২৮-৩১ ডিসেম্বর) বোম্বেতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৭২ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সিকি শতাব্দি পরে প্রতিষ্ঠিত হলো নিখিল ভারতীয় মুসলিম লীগ। সেটা ছিল ১৯০৬ সালে। ১৯০৯ সালে মলি মিস্টোর শাসনামলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। চালু হলো তথাকথিত কোটা ব্যবস্থা। ভোটের বেলায় হিন্দু আর মুসলমানেরা, যেহেতু এরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ছিল-  ভিন্ন ভিন্নভাবে ভোট দিত। এ ক’টা আসন হিন্দুদের জন্য, আর এ ক’টা মুসলমানদের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু ভোটাররা হিন্দু প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন আর মুসলমান ভোটাররা মুসলমান প্রতিনিধিদের ভোট দেবেন।
একভাবে বলতে গেলে এর মধ্য দিয়ে ভারতের অথবা উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হলো। এরও আগে অবশ্য বাংলাকে ১৯০৫ সালে ভাগ করা হয়েছিল। মূলত সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু সেটা বেশিদিন টেকেনি। তবে কমুøনাল অ্যাওয়ার্ড অথবা সেপারেট ইলেকটোরেট টিকে গেল এবং এক অর্থে বলা যায় শেষ পর্যন্ত ভারতকে বিভক্ত করলো।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, দেশ বিভাগের বিকল্প কি ছিল? অর্থাৎ অন্য কীভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার সংরক্ষিত হতো কিংবা হতে পারতো? এর জবাব খুব স্পষ্টঃ ইউরোপেও এক সময় ধর্ম নিয়ে হানাহানি ছিল। অন্যভাবে বলতে গেলে ইউরোপের বেশিরভাগ সময় জুড়েই ছিল বিভিন্ন ধরনের ধর্মযুদ্ধ। খ্রিস্টান ধর্মমতে স্বয়ং যীশুখ্রিস্টকে হত্যা করেছিল ইহুদিরা আর তাই পরবর্তী প্রায় দু-হাজার বছর ধরে খ্রিস্টান রাজারা ইহুদি ধর্মাবলম্বী পেলেই হত্যা করতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হয় অর্থাৎ আনুমানিক ৬০ লক্ষ ইহুদি হত্যার ভেতর দিয়ে পাশ্চাত্যের বিবেক জাগ্রত হয়। আবার ভিন্নভাবেও দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বিশ্ব রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু ইউরোপ থেকে আমেরিকায় চলে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত ইউরোপের ভিন্নমতাবলম্বীদের দ্বারা গঠিত। এই দলে ইহুদি ও প্রোটেস্টান্টদের সংখ্যাই বেশি। আর যেহেতু তারা ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে নতুন দেশে পালিয়ে গিয়েছিল তাই তারা পুরনো দেশের বর্বরতা ঝেড়ে ফেলতে চাইলো। তাই তারা প্রতিষ্ঠা করলো এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র আর ধর্ম আলাদা। সেখানে ধর্ম থাকবে অথবা থাকবে না এবং ধর্মীয় সংঘাত হলে রাষ্ট্র তা মীমাংসা করবে। রাষ্ট্র সেখানে সুপার রিলিজিয়ন হিসেবে আবিভূêত হয়। ধর্মের শাসনের পরিবর্তে আইনের শাসন চালু হয়।
আমেরিকায় বিপ্লবের ঢেউ ‘পুরনো’ দুনিয়াতেও পড়ে। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অবস্থায় প্রধান মিত্র ফ্রান্সে এর প্রথম ধাক্কা লাগে-  সৃষ্টি হলো ফরাসি বিপ্লব। এটা যেমন একদিকে রাজ-রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, অন্যদিকে এই বিদ্রোহের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ধর্ম আর ধর্মযাজকরা। কেননা, ফ্রান্সে সামন্তরা যতটা না সম্পত্তির মালিক ছিল গীর্জা তার চেয়ে ১/৩ ভাগ জমির মালিক ছিল। ফরাসি জনগণের তখন মনোভাব ছিল, গীর্জা আর সামন্তদের এত জমি থাকলে অন্যদের জন্য অবশিষ্ট থাকবে কি? তবে রাজনৈতিকভাবে যে সমাধানটা আসলো সেটা হচ্ছে রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। পরবর্তীকালে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও মোটামুটি একই আদলে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দুটো-  এক ধর্মের নামে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন থেকে নিস্তার আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা যেন শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বসবাস করতে পারে। রাষ্ট্র হবে নিরপেক্ষ ও মতামত মীমাংসাকারী একটি প্রতিষ্ঠান। আর যুক্তি ও আইন হবে এ সকল সমাধানের ভিত্তি।
তবে ইংরেজরা ভারতে সেই নীতি অনুসরণ করেনি। তারা মোটামুটি একটি ধর্মরাষ্ট্রের আদলেই উপমহাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করলো। আর এই উপমহাদেশের মানুষরাও সেই আদলের বাইরে যেতে পারেনি, যদিও সেই প্রচেষ্টা কম-বেশি সব সময়ই ছিল।
বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে মুসলমানেরা, এই দোটানায় সবচেয়ে বেশি ভুগেছে। হয়তো এটাই স্বাভাবিক ছিল, কেননা ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন এখানেই হয়েছিল। সেদিক থেকে উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন ঔপনিবেশিক শাসনের শিকার হয়েছিল বাঙালিরা। এতে যেমন একদিকে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-সংস্ড়্গৃতির সংস্পর্শ বাঙালিরা পেয়েছিল, আবার তাদের রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষারও লীলাভূমি হয়েছিল।
বাংলাতেই ইংরেজরা প্রথম রাজধানী গড়ে তোলে-  কোলকাতায়। আর এখানেই প্রথম আধুনিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো, হাইকোর্ট (১৭৭২), এশিয়াটিক সোসাইটি (১৭৮৪), যেমন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গড়ে উঠেছিল। আবার এখানেই সিপাহী-বিদ্রোহের প্রধান বিস্ফোরণ ঘটে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাও এখানেই ঘটে। আবার মুসলিম লীগের গোড়াপত্তন হয় এখানেই। এখানেই ১৯০৫ সালে বঙ্গদেশকে বিভক্ত করে ধর্মের ভিত্তিকে দু’টি পৃথক প্রদেশ করা হয়। আন্দোলনের মুখে তা ১৯১১ সালে রদ করা হলেও দশ বছর পর কমুøনাল অ্যাওয়ার্ড বা সাম্প্রদায়িক উপহার দিয়ে তা ভিন্নভাবে আসলো।
উপনিবেশ-উত্তর অনেক রাষ্ট্রের মতই উপমহাদেশের রাষ্ট্র গঠনে অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। অনেক দেশেই নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় তা সমাধান হয়েছে, আবার অনেক জায়গায়ই পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। জটিলতার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দক্ষিণ সুদান, যা দাফুর হিসেবে বেশি পরিচিত। বড় একটি গণহত্যার ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশটি স্বাধীন হয়ে রাজনৈতিক একটা সমাধান পাওয়া গেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সুদান বৃটিশ উপনিবেশ ছিল আর প্রধানত মুসলমান অধুøষিত ছিল, তবে দক্ষিণটা ছিল খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এ ধরনের সমাধান ইথিওপিয়াও হয় যেখানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ-  এরিত্রিয়ার স্বাধীনতার মাধ্যমে সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধান হয়। তবে নাইজেরিয়া কিংবা কঙ্গোতে সংখ্যালঘুরা এতটা সৌভাগ্যবান ছিল না। নাইজেরিয়ার খ্রিস্টান অধুøষিত বায়ফরা প্রদেশ দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেও স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি, যেমন পারেনি কঙ্গোর কাতাঙ্গা প্রদেশ।
অবশ্য যুদ্ধই সংখ্যালঘু সমস্যার একমাত্র সমাধান নয়। ইন্দোনেশিয়ার সাথে মালয়েশিয়ার দীর্ঘদিন বিরোধ ছিল যাকে বলা হতো ‘কনফ্রোন্টাসি’। দু’দেশই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু ইন্দোনেশিয়া ছিল ওলন্দাজ উপনিবেশ আর মালয়েশিয়া ছিল ব্রিটিশ। অনেকটা সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসেবেই সঙ্কটটা বিরাজ করছিল। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে রাষ্ট্র গঠনে মালয়েশিয়া-  ইন্দোনেশিয়ার আর কোনো সমস্যা নেই। অনেকই রয়েছে, তবে  আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
উপমহাদেশের রাষ্ট্র ভাবনার সবচেয়ে জটিল বহিঃপ্রকাশ হয়েছে বাংলাদেশে। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে এখানেই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়ে উঠেছিল সংখ্যালঘুদের আন্দোলন। সেটা কেন হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। তবে প্রায় সবাই একমত যে, তৎকালীন বঙ্গদেশে-  অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে-  মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও হিন্দুদের তুলনায় পশ্চাৎপদ ছিল। এটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সত্য ছিল-  যেমন শিক্ষায়, তেমন সম্পদে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানরা এর একটা সমাধান চাইতেন। অর্থাৎ তারা হিন্দুদের সমপর্যায় আসতে আগ্রহী ছিলেন। এর প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে ‘দি স্পিরিট অব ইসলাম’- খ্যাত লেখক ও বিশিষ্ট বাঙালি বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আমির আলীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হলো ‘মোহম্মাডেন এডুকেশন সোসাইটি’-  যার মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের অনগ্রসরতা দূর করা। এই সোসাইটির সাথে বাঙালি ও ভারতীয় অনেক মুসলমান বুদ্ধিজীবীই জড়িত ছিলেন। কিন্তু ১৯০৬ সালে যখন এই সোসাইটির নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে গেলেন, অনেকেই এর বিরোধিতা করলেন। যেমন সৈয়দ বদরুদ্দিন তাব্রাজি, যিনি তখন কংগ্রেসের সভাপতি, তাকে মুসলিম লীগে যোগদানের জন্য সৈয়দ আমীর আলী চিঠি লিখলেন। তাব্রীজি জবাবে বলেন, ‘দেখুন আমি ‘মোহাম্মাডেন এডুকেশন সোসাইটি’তে জড়িত থাকলেও মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি ভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠনের পক্ষপাতি নই। কেননা, বাংলাদেশে মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে থাকলেও তা সারা ভারতের জন্য সত্য নয়। বরঞ্চ বেশিরভাগ জায়গায় চিত্রটা প্রায় উল্টো। যেমন, কর্ণাটক, (যেখানকার অধিবাসী তিনি ছিলেন,) সেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হলেও শিক্ষা, সম্পদ, সংস্ড়্গৃতিসহ সব ক্ষেত্রেই হিন্দুদের চেয়ে এগিয়ে আছে। প্রায় একই চিত্র ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও। বাংলার সমস্যাটা ব্যতিক্রম এবং তিনি মনে করতেন, এটা শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সমাধান করা যাবে।
তাব্রীজির এই ব্যাখায় অনেকেই সন্তুষ্ট হননি, আবার অনেকে হয়েছিলেন। তবে অনেকে আবার মনে করেন সমস্যাটা শুধু শিক্ষার নয়, ঐতিহ্যেরও।
মুসলিম লীগের তাত্ত্বিকরা মনে করেন, ইংরেজরা আসার আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ বাদশাহী ও মোঘল আমলে মুসলমানরা ফার্সি শিক্ষার সুবাদে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে ছিলেন। আর ১৮৩৬ সালে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন রাষ্ট্রভাষা পরিবর্তন করে ফার্সি থেকে ইংরেজি চালু করে, তখন গোটা একটি সম্প্রদায় রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ হয়ে গেল।
ঐতিহাসিকভাবে এ কথাটি সত্য নয়। আর বাংলাদেশের জন্য তা মোটেই সত্য নয়। কেননা নবাবী বা বাদশাহী আমলে নবাব বা রাজা মুসলমান হলেও তার সভাসদ ও আমলারা-  যারা ফার্সি শিক্ষিত ছিলেন-  তারা বেশির ভাগই হিন্দু ছিলেন। নবাব আলীবর্দী খানের সভাসদের দিকে তাকালেই অবস্থাটা বোঝা যায়। দু’একজন ছাড়া এবং তারা বেশির ভাগই নবাবের আত্মীয়, সভাসদ প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। তবে অনাত্মীয়ও দু’একজন ছিলেন, যেমন-  গোলাম হোসেন, যিনি সভার প্রধান করণিক, ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিত হিসেবে কাজ করতেন।
স্বাভাবিকভাবেই বাদশাহী ও মোঘল আমলের শিক্ষিত শ্রেণীই কোম্পানি আমলে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করেন। একে তো তাদের সুযোগ বেশি ছিল, আর এ কথাও মনে রাখতে হবে এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্পও ছিল না। তারা যুদ্ধেও পারদর্শী ছিল না, তাদের তেমন কোনো সম্পদও ছিল না। তাই জীবিকার জন্য শিক্ষাই তাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্ব পুরুষরাও কোম্পানি শাসনের আগে থেকেই বাংলার অন্যতম ধনী ও শিক্ষিত পরিবার ছিল। পলাশীর যুদ্ধের সময় তাদের আটটি কোম্পানি ছিল যার মধ্যে একটি স্টিমশিপ কোম্পানিও ছিল। উমি চাঁদ সম্বন্ধে বলা হয় যে তিনি এত বড় ব্যাংকার ছিলেন যে তার হুন্ডি সুদূর এথেন্সেও গ্রহণযোগ্য ছিল। রাজা রাম মোহন রায় এই শ্রেণীর একটি ভালো উদাহরণ। তিনি যেমন মোঘল রাজসভায় বিশ্বস্ত ছিলেন ঠিক তেমনই তিনি রানী ভিক্টোরিয়ারও আস্থাভাজন ছিলেন। শিক্ষা কিংবা ঐতিহ্য-  বাংলার মুসলমান অনগ্রসরতার কারণ যাই হোক-  পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গে তথা উপমহাদেশের এই ভূখণ্ডে মুসলিম লীগ তথা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি উৎসাহিত করার  পেছনে অনেকেরই অবদান আছে। অনেকেই আবার চেষ্টা করেছেন অসাম্প্রদায়িক ধারা গড়ে তুলতে। দু’টো ধারাই সব সময়ই ছিল। তবে কেউই তাদের আদর্শের কোনো স্থায়ী অথবা স্থিতিশীল রূপ দিতে পারলেন না।
সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রথম স্পষ্ট ধারা দেখা যায় ঊনবিংশ শতাব্দিতে। ‘বেঙ্গল রেনেসাঁ’-র কৃতিপুরুষ-  ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রভৃতি বুদ্ধিজীবীরা অসাম্প্রদায়িক চেতনারই ধারক ছিলেন। একই সময় প্রভাবশালী বাঙালি মুসলমান লেখক জামালউদ্দিন আফগানীও একই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আমাদের চেতনাকে এতটাই প্রভাবিত করেছে আজ আফগানীর কথা আমাদের দেশে উচ্চারিত হয় না। আমরা মালয়েশিয়া ও মার্কিন লেখকদের মাধ্যমে তার প্রাথমিক পরিচিতি পাই।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিবর্তন বঙ্কিম চন্দ্রের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় প্রথম জীবনে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা করে ‘বাংলার কৃষক’ নামে একখানা লেখা উপহার দিলেও অচিরেই ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার প্রথম দিকের লেখা সম্বন্ধে তিনি নাকি বলতেন, ‘প্রথম যৌবনের বিভ্রান্তি’। অন্য দিকে জালালউদ্দিন আফগানীর মৃতুøর পর সবচেয়ে খ্যাতিমান মুসলমান বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আমির আলীও ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন।
এই ধারাকে প্রথম বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। কোলকাতা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি শের-ই-বাংলা বলে খ্যাত এ· কে· ফজলুল হককে ডেপুটি মেয়র মনোনীত করেন। ফজলুল হক তখন মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। হক অবশ্য কিছু দিনের জন্য একই সাথে লীগের সভাপতি ও কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দেশবন্ধু শুধু শের-ই-বাংলাকেই তার সহকারী করলেন না কোলকাতা সিটি করপোরেশনের সকল নিয়োগের শতকরা ৮০ ভাগ মুসলমান নেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেন-  যতদিন আনুপাতিক সমতা না আসবে-  ততদিন পর্যন্ত। কিন্তু সি আর দাশের অকাল মৃতুøর কারণে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খায়।
পরবর্তীকালে ফজলুল হক যখন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন-  ১৯৩৭ সালে-  তিনি বাংলার কৃষক-প্রজাদের স্বার্থে ঋণ-সালিশী বোর্ড স্থাপন করলেন। কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা-  এই দুই দলই এর বিরোধিতা করলো। মুসলিম লীগ এটিকে সমর্থন করলো। অনেক ঐতিহাসিকের এবং রাজনীতিবিদদের মতে এটিই ছিল বাংলার তথা ভারতবর্ষের আধুনিককালের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। উত্তর প্রদেশের এক সময়কার মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত কুমার বহুগুণা এই সম্বন্ধে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘কংগ্রেস হিন্দু জমিদারদের পক্ষ অবলম্বন করায়, শুধু তার আদর্শ থেকেই বিচুøত হয়নি বরঞ্চ বাংলার কৃষকদের মাঝে তার অবস্থান চিরতরে হারায়। এরই অবশ্যম্্‌ভাবী পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়।’
শুধু ঋণ-সালিশী বোর্ডের কারণেই পাকিস্তান সৃষ্টি হয়-  এ কথা হয়তো অনেকেই মানবেন না-  আর এটা বিশ্বাসযোগ্যও নয়। কেননা কোনো কিছুই কেবল একটি কারণে হয় না। একাধিক কারণ থাকতে হয়। তবে এটা সত্য, এই ঘটনা হিন্দু প্রভাবিত দলগুলোর সাথে মুসলমান দলগুলোর দূরত্ব আরও বেশি বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ ইংরেজদের কমুøনাল অ্যাওয়ার্ড যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল তা পূরণ হলো। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলায় বেশিরভাগ জমিদার হিন্দু ছিলেন আর প্রজারা বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান। সমগ্র অবিভক্ত বাংলায় শুধু পাঁচটি মুসলমান জমিদারি ছিল। শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রায় একই অবস্থা ছিল।
তবে জনসংখ্যায় বেশি থাকার কারণে যখন সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশে সরকার প্রথা চালু করা হয়, ১৯৩৭-এ, তখন মুসলমান প্রভাবিত দলগুলোই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে সংসদে আবিভূêত হয়। নির্বাচনে কংগ্রেস, কেএসপি ও টহরঃবফ গঁংষরস চৎড়মৎবংংরাব চধৎঃু প্রায় সমান সংখ্যক আসন পায়। হক সাহেব কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশনের প্রস্তাব দিলে নেহেরু তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ফজলুল হক টহরঃবফ গঁংষরস চৎড়মৎবংংরাব চধৎঃু-র সঙ্গে সরকার গঠন করেন এবং নিজে মুসলিম লীগে যোগ দেন। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ছিলেন হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। (হিন্দু মহাসভাই পরবর্তীকালে জনসংঘ হয়। তাদের একজন কর্মী নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে ফেলার পর এ জনসংঘ পরবর্তীকালে জনতা পার্টিতে বিলীন হয়ে নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি নামে আবার আবিভূêত হয়।)
এতে অবশ্য অনেক মুসলমানই ক্ষুব্ধ হয়। পরবর্তীকালে ফজলুল হক ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় একটি খাদ্য বোঝাই জাহাজ কোলকাতা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা গমনে বাধা দিলে তার সরকারকে ব্রিটিশরা বদলে দিয়ে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। ফজলুল হক হিন্দু মহাসভার সাথে কোয়ালিশন করার অপরাধে পরের নির্বাচনে-  ১৯৪৬ সালের ভোটে-  সিট পান সারা বাংলায় মাত্র তিনটি। তিনি পটুয়াখালী ও খুলনা থেকে নির্বাচিত হন আর তার দলের নেতা আবু হোসেন সরকার রংপুর থেকে। তবে কৃষক-প্রজা পার্টি হারলেও বেশ ভালো সংখ্যক ভোট পায়।
যেমন ১৯৪৭ সালে সিলেট রেফারেন্ডাম বা গণভোটে শতকরা ৫৫ ভাগ ভোট পরে পাকিস্তানের পক্ষে অর্থাৎ শতকরা ৪৫ ভাগ ভোট পরে ভারতের পক্ষে। এ ছাড়াও সিলেটের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তখন সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর-  বিশেষ করে খাসিয়া মনিপুরী ছিল। এ ছাড়াও চা-বাগান শ্রমিকরা ছিল। নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভোট নিলে হয়তো ভিন্ন চিত্র দেখা যেতো। আসামে অহমিয়া জনগণ এতে খুশিই হয়েছিল। তারাও সিলেট আসামের সঙ্গে থাকুক তা চায়নি।
সিলেট ১৯০৫ সালের আগ পর্যন্ত বাংলার একটি জেলা ছিল। যখন বঙ্গভঙ্গ হয়ে পূর্ববঙ্গ আর আসামকে আলাদা করা হলো তখন সিলেটকে আসামের সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও সিলেট আসামের অংশ থেকে যায়। ১৯৪৬ সালে যখন আসামের বিধানসভা পার্টিশানের বিরুদ্ধে ভোট দিল তখন সিলেটে আলাদা গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীও তখন ছিলেন একজন মুসলমান, স্যার সাদুল্লাহ। তিনি জামিয়াতে উলামায়ে হিন্দ দলের নেতা ছিলেন। আর মুসলিম লীগ ছিল বিরোধী দলে। দলের সংসদে ও বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, আসাম বিধান সভায় ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ দুই ভোটে পরাজিত হয়েছিল।
প্রান্তিক ভোটেই দেশ বিভক্ত হলো। আর লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণ হারালো। এটা কি ঠিক হয়েছিল? গণতন্ত্রের দার্শনিক জঁ জ্যাক রুশো তার বিখ্যাত ‘দি সোশাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থে বলেছেন, ভিন্ন মতালম্বীদের অধিকারই গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি। পাকিস্তান সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া সেখানে এটা কতটা প্রতিফলিত হয়েছিল? আর এটা শুধু বাংলা এবং আসামের নয় সমগ্র উপমহাদেশেই একই চিত্র। পাঞ্জাবে স্যার সিকান্দার হায়াৎ খানের নেতৃত্বে সংহতিপন্থী ইউনিয়নিস্ট পার্টির সরকার ছিল। তারা প্রচণ্ডভাবে ভারত বিভক্তির বিরোধী ছিল কিন্তু পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ রায়ট বাঁধিয়ে পার্টিশন অনিবার্য করে তোলে। বলা হয়ে থাকে, শিখ-মুসলমান সেই রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা এতই ভয়াবহ ছিল যে তাতে প্রায় ৬ লক্ষ লোক মারা যায়। পশ্চিম পাঞ্জাবের জনসংখ্যার দিকে তাকালেও সেটা বোঝা যায়, প্রায় কোনো হিন্দু কিংবা শিখ নেই! প্রায় একই অবস্থা পূর্ব পাঞ্জাবে, এখন যেটা পাঞ্জাব ও হরিয়ানা-  দুইটি রাজ্যে বিভক্ত। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও ‘সীমান্ত গান্ধী’ খান আবদুল গাফ্‌ফার খানের নেতৃত্বে খোদ কংগ্রেস সরকারই ছিল তবুও দাঙ্গার মুখে সেই অঞ্চলকেও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে হলো। অর্থাৎ সংখ্যালঘু এবং ভিন্নমতালম্বীই নয়, অনেক জায়গায়ই সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতেরও তোয়াক্কা করা হয়নি। ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের কাবু করা হয়েছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে-  নবগঠিত রাষ্ট্রের অসন্তোষ বেঁধে রইলো। স্বভাবতই তাই বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই অসন্তোষ দানা বাঁধে। পরে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পূর্ববঙ্গে।
যেহেতু পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে ছিল এবং লাগোয়া ছিল না তাই এর পরিণতিও ভিন্ন হয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর প্রথম যে নির্বাচন হয়, তাতে শাসক দল মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মুসলিম লীগ বিরোধী দলগুলো একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করে তাকে পরাজিত করে। প্রধানত তিনটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, শেরে বাংলা এ· কে· ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা পার্টি এবং মাওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে নিজাম-ই-ইসলামী। প্রথমোক্ত তিনজন-  ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক দেশ বিভাগের আগে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। মুসলিম লীগ তাকে পরিত্যাগ করলে শ্যামা প্রসাদের সঙ্গে কোয়ালিশন করেন। আর সোহরাওয়ার্দী ঢাকার নবাব খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে দ্বন্দ্বে নতুন দেশে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ বা ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষিত হন। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ মারা যাওয়ার পর তার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং তিনি পাকিস্তানে আসতে পারেন। বাংলার দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর যখন এই দশা তখন আসাম থেকে আসা মওলানা ভাসানী তো কোনো পানিই পেলেন না। তাই তাদের এক জোট হওয়াটা যেন অনেকটা স্বাভাবিক ছিল।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রায় সবক’টি সিট পায় এবং ভোটের শতকরা ৭৪ ভাগ পায়। আর ফ্রন্টের মূল দাবি ছিল (পূর্ব বাংলার) স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু সারা পাকিস্তানে নির্বাচন না হওয়ায় যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পাকিস্তানের ৮২ সদস্যের জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘুই রয়ে গেল। এই অচলাবস্থা ভাঙ্গার জন্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য, সোহরাওয়ার্দী ১৩ মাসের জন্য একটি মাইনরিটি গভর্নমেন্ট বা সংখ্যালঘু সরকার পরিচালনা করেন। তার দলের সংসদ সদস্য ছিলেন মাত্র ৮ জন-  দশ শতাংশও নয়। মূলত পাঞ্জাব ভিত্তিক রিপাবলিকান পার্টি-  যার ২৫ জন সদস্য ছিল, তার সমর্থনে সরকার চালান সোহরাওয়ার্দী। তারা সরকারে যোগ দিতেও রাজি হননি এবং তারা যখন সমর্থন তুলে নিলেন তখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো। অবশ্য পরবর্তী সরকার-  ফিরোজ খান নুনের নেতৃত্বে, সেটা তাদের দলেরই সরকার ছিল। তৎকালীন   পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইসকান্দার মির্জাও তাদের সদস্য ছিলেন। মূলত এই দলের সহায়তাই ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে নির্বাচনের দুই মাস আগে পাকিস্তানে সামরিক অভুøত্থান ঘটে এবং জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতাসীন হন।
স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিরোধী দলের রাজনীতি ছিল অসাম্প্রদায়িক। সামরিক শাসনের আগ পর্যন্ত আর একটি বড় ইসুø ছিল স্বায়ত্তশাসন। তাই পঞ্চাশের দশক ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা বিকাশের কাল আর ষাটের দশক ছিল গণতন্ত্র অর্জন ও আইনের ভেতর দিয়ে জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশের প্রচেষ্টা। বাংলা ভাষা ও সংস্ড়্গৃতির প্রতি পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরূপতা এবং রবীন্দ্রবিরোধিতা যত প্রবল হয়েছে, ততই বাঙালিদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনাও জোরদার হয়েছে। পাকিস্তানের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত জোরালোভাবেই উন্মেষ ঘটতে থাকে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৯ সালে গণঅভুøত্থান ঘটলে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইতে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব হেরে গেলেন এবং নতুন সামরিক শাসক সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসতে হলো।
এর আগে স্বায়ত্তশাসনের জন্য ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং এর সমর্থনে ৭ জুন দেশব্যাপী হরতাল ডাকেন। হরতাল সফল হলেও এই আন্দোলন বিভিন্ন কারণে আর বেশি অগ্রসর হয়নি। পরবর্তীকালে ৬-দফা ছাত্র সমাজের ১১-দফার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ’৬৯-এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবির অংশ হয়।
স্বাভাবিকভাবেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যতই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করেছে, ততই বিরোধী দলগুলো অসাম্প্রদায়িক হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, আওয়ামী লীগ আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে ১৯৪৯ সালে আবিভূêত হয়। কিন্তু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর অভিজ্ঞতার আলোকেই ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলটি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির সমর্থন পাওয়ার পথ সুগম হয় এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
১৯৫২ কিংবা ১৯৪৮ থেকেই যে ভাষা আন্দোলন বিকশিত হতে শুরু করে তা মূলত বাঙালিদের সাংস্ড়্গৃতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্য-  সেখানে ধর্মের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই ছিল না। এই সময়ের রাজনীতি বুঝতে গেলে অবশ্য আর একটি বিষয়ও বুঝতে হবে। আর তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের ভূমিকা। তখন কমিউনিস্ট ব্যবস্থার সূর্য মধ্যগগণে, তাই সে সময় এই ভূখণ্ডের প্রায় সব আন্দোলন তথা রাজনৈতিক ঘটনায় কমিউনিস্টদের একটা ভূমিকা ছিল।  পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর যেখানে সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক কিংবা ভাসানীর মতো বর্ষীয়ান মুসলিম লীগ নেতাদের কোনো পাত্তা ছিল না, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্টদের অবস্থা কেমন ছিল তা কল্পনা করতে কষ্ট হয় না। শাসকগোষ্ঠীর চরম নিবর্তনমূলক ভূমিকার কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত কমিউনিস্ট নেতারা দেশত্যাগে বাধ্য হন কিংবা চরম প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আত্মগোপনে গিয়ে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে থেকে কিংবা ওই সব দলে যোগ দিয়ে কাজ করতে থাকেন। এমনও মনে করা হয় যে, আওয়ামী মুসলিম লীগের মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার পেছনে তারাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অবশ্য অন্যান্য কারণও নিশ্চয় ছিল। যেমন কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা যারা পূর্ববঙ্গে রয়ে গেলেন-  হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে-  তাদেরও নিশ্চয়ই একটা ভূমিকা ছিল। অনেকে-  যেমন আবুল মনসুর আহমেদ তো সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। এক কথায় বলা যায়-  সমগ্র মুসলিম লীগবিরোধী শিবিরই তখন আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক অবস্থান গ্রহণ করাতে নেমে পড়ে, যদিও কমিউনিস্টদের ভূমিকাটা অনেক বেশি সক্রিয় ছিল, কেননা গোপনে তারা তাদের দল বজায় রেখেছিল। অন্যরা যেমন কংগ্রেস-  পাকিস্তানে তার কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পায়নি-  তাই তারা দলটি গুটিয়ে ফেলে।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনেও কমিউনিস্টরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির আত্মগোপনরত খোকা রায়, অনিল মুখার্জি প্রমুখ নেতারা ছাড়াও যারা প্রকাশ্যে কাজ করতেন যেমন শহীদুল্লাহ কায়সার, তারাও ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আবদুল মতিন-  যিনি ‘ভাষা মতিন’ নামে পরিচিত, তিনিও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেই জড়িত ছিলেন।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য, বিশেষত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থানের প্রশ্নে বিতর্কের পথ ধরে মূলত কমিউনিস্টদের অবস্থানের কারণেই ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে যায় এবং কমিউনিস্ট প্রভাবিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী এই নতুন দলেরও সভাপতি হন। আওয়ামী লীগের এই ভাঙন যথার্থ ছিল কি-না সে প্রশ্ন অবশ্য তোলা যেতেই পারে। কারণ এতে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তীব্রতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটা সাময়িককালের জন্য হলেও।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয়
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক পরিবেশটা পুরোপুরি পাল্টে যায়। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের জনপ্রিয় আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হলো নতুন রাষ্ট্র। আর সময়ের ধারাবাহিকতায় যোগ হলো সমাজতন্ত্র। জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের পরিবর্তে এলো জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা। ১৯১৮ সালে যে দাঙ্গার রাজনীতি শুরু তার সর্বশেষ প্রকাশ ঘটে ১৯৬৪-তে আর সর্বোচ্চ প্রকাশ ১৯৪৬ সালে। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই অধ্যায়ের শেষ হলো। উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের আগেও বাংলাদেশের বৃহত্তম পাটকল আদমজীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হয়। আবার ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বেও ১৯৬৪ সালে সংঘঠিত হয় আরেক দফা দাঙ্গা। ১৯৬৪ দাঙ্গা থামানোর জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরলস প্রচেষ্টা ছিল। তার ‘পূর্ব বাঙলা রুখিয়া দাঁড়াও’ লিফলেট সে সময় যাদুর কাঠির মতো কাজ করেছিল।
তিনি সঠিকভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন এই দাঙ্গা-রাজনীতির বলয় থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে বাঙালির অধিকার কখনই প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। এ ছাড়াও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরাও দাঙ্গাবিরোধী মনোভাব সৃষ্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। মূলধারার রাজনীতি বিশেষ করে ছাত্র, শ্রমিক ও সাংস্ড়্গৃতিক ফ্রন্টে কমিউনিস্টদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতি খুব দুঃখজনক রূপ ধারণ করে। উগ্র বামপন্থী ্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও শ্রমিক ফ্রন্ট ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। প্রচণ্ড সরকার-বিরোধী ভূমিকা নিয়ে তারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও প্রকারন্তরে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির উত্থানের পথ প্রস্তুত করে। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে নতুন দেশের সংবিধান প্রণীত হয় এবং ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম প্রভৃতি রাজনৈতিক দলসমূহের কোনো অস্তিত্ব বা অংশগ্রহণ ছিল না। নির্বাচনে সরকার প্রায় সব ক’টি আসনে জয়ী হয়। আর দ্বিতীয় বৃহৎ সংসদীয় গোষ্ঠী হিসেবে আবিভূêত হয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা-  তারা ১১টি আসনে জয়ী হয়। আর জাসদ ও আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগ একটি করে আসনে জয়ী হয়। পরে উপ-নির্বাচনে জাসদ আরও একটি আসন পায়। ১৯৭৪ সালের শেষ ভাগে একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য, আবদুল্লাহ সরকার, জাসদে যোগ দিলে জাসদের মোট সংসদ সদস্য সংখ্যা ৩-এ উন্নীত হয়। অন্যদিকে রাজবাড়ি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কামরুল ইসলাম ভাসানী ন্যাপে যোগ দিলে ঐ দল সাধারণ নির্বাচনে কোনো আসন না পেলেও প্রথম সংসদে একটি আসন পায়। অন্য আরেকটি বিরোধী দল-  মোজাফফর ন্যাপ- সাধারণ নির্বাচনে জাসদের মতোই শতকরা ৪ ভাগ ভোট পেলেও সংসদে কোনো আসন পায়নি। আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি ৮টি আসনে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে প্রতীকী অংশগ্রহণ করে। উল্লেখ্য, গোটা পাকিস্তান আমল জুড়েই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় প্রকাশ্যে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেনি। তবে তারা প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর তারা স্বনামে প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। ফলে স্বাধীনতার পর বাস্তব কারণেই কমিউনিস্ট পার্টির তেমন গণভিত্তি ছিল না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকার যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি খুব ভালোভাবে সামাল দিতে পেরেছে-  এটা বলা যাবে না। একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলা-বারুদ বাইরে রয়ে গেল, অন্যদিকে জাসদ সৃষ্টি হওয়ার পর সরকার দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে থাকে। জাসদ ছাড়াও অন্যান্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চীনপন্থী গোপন দলগুলো চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। এ ছাড়াও এক সময়ের কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) ও ‘ভাষা’ মতিনের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) অন্যতম। এরা প্রায় সবাই চীনপন্থী ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় গণচীনের ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের অভুøদয় মেনে নিতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে বামপন্থী খোলসে বাংলাদেশের বিরোধিতা করা খুব সহজ ব্যাপার হয়ে ওঠে। গোপন সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়তে থাকে। অসংখ্য থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা  ও লুট করা হয়। বেশ কয়েকটি পাটের গুদামে আগুন ধরানো হয়।
আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতার সাথে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের উপর্যুপরি বন্যা এবং আমেরিকার ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি জাতীয় দলের নাম ঘোষণা করেন-  বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ -  সংক্ষেপে বাকশাল। জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। সিরাজ সিকদারসহ আরও অনেকে গ্রেপ্তার হন। এর আগে ‘ভাষা মতিন’ও গ্রেপ্তার হন। থানা লুটের সংখ্যাও কমে আসে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটতে থাকে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে   যবনিকাপাত ঘটে বাকশালের এবং সাথে সাথে পরিসমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা ধারণকারী রাজনৈতিক ধারার।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিদের মধ্যে অনৈক্যের সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরা। বঙ্গবন্ধু-উত্তর বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করা হয় তার শিরোমণি ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি পর্যায়ক্রমে সামরিক ফরমান বলে সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন করে জামায়াতসহ নিষিদ্ধ দলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতাকারী চীনপন্থী রাজনৈতিক দল ও দলাংশ এবং মুসলিম লীগসহ অন্যান্য ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক দল ও ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তোলেন প্রথমে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট, পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
এটা ঠিক যে, প্রবণতার দিক থেকে ভাবতে গেলে এই প্রবণতা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ প্রথম ভাষণ শেষ করেন ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে। এ ছাড়াও ‘বাংলাদেশ বেতার’-এর নাম ‘রেডিও পাকিস্তানের’ আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করা হয়। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, এগুলো খুব বেশি কিছু নয়, তবে এর প্রতীকী অর্থ অনেক গভীরে প্রোথিত। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও তার প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন স্ব-মূর্তিতে আবিভূêত হন, তখন নতুন উত্থিত রাজনৈতিক সরকারের রাজনীতি ও আদর্শ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি এতই প্রতিক্রিয়াশীল ও নেতিবাচক হয়ে ওঠে যে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারতীয় ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিদের ভারতীয়দের এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা শুরু হয়। দেশপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা আমদানি করা হয়। যারা যত সাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তারাই তত দেশপ্রেমিক। জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর রইলো না; জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠলো ‘বাংলাদেশী’ যা ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’-এর নামান্তর। সমন্বয় ও সমঝোতার রাজনীতির নামে জিয়াউর রহমান দেশের প্রধানমন্ত্রী বানালেন একজন কুখ্যাত ‘রাজাকার’ শাহ আজিজুর রহমানকে ও পাকিস্তানি নাগরিক গোলাম আজমকে দেশে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হয়।
জিয়াউর রহমানের হত্যার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক ধারার সমাপ্তি না হয়ে বরং সেটাকে পুঁজি করে আজও তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদী’ শক্তি বেঁচে আছে। আর জিয়াউর রহমানের মৃতুøর পর প্রায় ৮ বছর দেশ শাসন করেন আরেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিও ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-কেই আদর্শ করে পথ চলেছেন। তবে এটা বলতে হয় যে, জিয়ার মতো তিনি ‘রাজাকার-পুনর্বাসন’ কর্মসূচি গ্রহণ না করলেও তাদের প্রতিপালনের কর্মসূচি তারও ছিল। আর নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে সামরিক ফরমান বলে ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মাথায় কুঠারাঘাত করেন এবং স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে রেখে যান।
এরশাদ তার শাসনামলে জনভিত্তি বাড়ানোর জন্য বার বারই ধর্মকে ব্যবহার করেছেন। এমনকি ক্ষমতাচুøত হওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে বিভক্ত করার জন্য ১৯৯০ সালের নভেম্বরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বাঁধিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, দাঙ্গাবাজরা সরাসরি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সভা থেকে শাঁখারিবাজারে চলে যায়। যদিও বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজ সেই দাঙ্গা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র-  দুটোই ঠেকিয়ে দিয়েছিল কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের কাছে এটা একটা কালো অধ্যায় হয়ে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ সংখ্যালঘু হিসাবে দেখা যায়। কিন্তু আগে এটা ছিল ১৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৮ শতাংশ মানুষ দেশত্যাগী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশও যে সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমি হয়ে উঠতে পারেনি সেটা কি অস্বীকার করা যাবে?
১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসে উগ্র-সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় দল জামায়াতে ইসলামীর হাত ধরে। সেটা হয়তো খানিকটা স্বাভাবিক ছিল, কেননা আদর্শিক দিক দিয়ে তারা একে অপরের অনেক কাছাকাছি। বিএনপি-জামায়াতের যৌথ রাজনীতি দেশে সাম্প্রদায়িক ও উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাকে দুর্বল করার জন্য রাষ্ট্রীয় মদদে নানা উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৎপরতা শুরু করে।
২০০১ সালে এই দুই অপশক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর। তারা আওয়ামী লীগের ‘ভোট ব্যাংক’-  এই অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, অপহরণসহ অকথ্য সব নির্যাতন চালানো হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। এই তাণ্ডব বেশ কয়েক মাস ধরে চলে এবং বলা হয়, কেবলমাত্র গণমাধ্যমের সমালোচনা ছাড়া সরকারকে আর কোনো বড় বাধার সম্মুখীন হতে হয় নি। প্রায় অবাধভাবেই এই নির্যাতন চালিয়ে যায় ‘জাতীয়তাবাদী-মৌলবাদী’ শক্তি।
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় বসার পর পরই পরোক্ষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মাঠে নামে ‘বাংলা ভাই’। তারা রাজশাহীর বাগমারায় তাণ্ডব সৃষ্টি করে এবং পরে তাদের ‘আন্দোলন’ দেশের তেষট্টিটি জেলায় পাঁচশত বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে। ঝালকাঠি ও গাজীপুরে আদালতে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়। এসব হামলায় দু’জন বিচারকসহ বেশ কয়েকজন মানুষ মারা যায়। তবে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত চারদলীয় সরকার ‘বাংলা ভাই’ ও তার কথিত আধ্যাত্মিক গুরু শায়খ আবদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়। এক-এগারোর পর ফখরুদ্দিনের ‘বিশেষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পরই কেবল বাংলা ভাই ও তার গুরুর মৃতুøদণ্ড কার্যকর হয়।

তাহলে কি করার কিছুই নেই?
সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গড়া দেশের মধ্য থেকেই বাংলাদেশের অভুøদয়। তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতার শেকড় গজানোর সহায়ক পরিবেশ থাকাটাই স্বাভাবিক। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, এমন অনেক মুসলমানও নিজের নাম আরবিতে হওয়া সত্ত্বেও সন্তানদের নাম রেখেছিলেন খাঁটি বাংলায়। এমন অন্তত দু’জনের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। একজন তার ছেলের নাম রেখেছিলেন সুব্রত চয়ন এবং মেয়ের নাম সুস্মিতা শম্পা এবং আরেকজন ছেলের নাম রেখেছিলেন প্রভাত সমীর। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করলাম সেই দেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আরো বিকাশ ঘটবে বলে স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল। কারণ সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্র-দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেই বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রায় সকল নাগরিক। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় অন্যতম আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
অবশ্য এটাও ঠিক যে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দেশের সব মানুষ রাতারাতি গ্রহণ করে ফেলার মতো বিষয় নয়। তাছাড়া দীর্ঘদিন দেশের মানুষ একটি ধর্মীয় আবহে বেড়ে উঠেছে, মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বঞ্চনাবোধ কাজ করায় তাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে এক ধরনের ‘মাইন্ডসেট’ তৈরি হয়েছিল। হিন্দু ও ভারত বিরোধিতা ছিল যার বহিঃপ্রকাশ। সেখানে পরিবর্তন আনার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ-প্রচেষ্টা রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্ড়্গৃতিকভাবে গ্রহণ করা দরকার ছিল সেটা সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়েই করা হয়নি। দেশের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যখন ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির বিরোধিতা করেছে তখন বরং ধর্মের পক্ষেই অবস্থান নিয়ে নানা যুক্তি উপস্থাপনের চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার যে সুযোগ ও সম্্‌ভাবনা তৈরি হয়েছিল, দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থানের অভাবে তা কার্যকর হয়নি।
আর পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয় তার ফলে মুক্তিযুদ্ধের ধারা শুধু ব্যাহত হয় তা-ই নয়, দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তালেবানি বা ইসলামি জঙ্গিধারার কর্মকাণ্ড যদিও অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক, কিন্তু এর বীজ বপন করেছে আওয়ামী লীগ শাসন-উত্তর সরকার, যার শীর্ষে ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। স্বদেশে নাগরিকত্ব হারানো, পাকিস্তানে আশ্রয়প্রাপ্ত, জামায়াত নেতা গোলাম আজমকে তিনি কৌশলে শুধু দেশে ফিরিয়ে আনেন, তাই নয়, তার অবৈধ অবস্থানকে বৈধ করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশও সৃষ্টি করেন। সংবিধানে নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক দল গঠনের অনুমতি (৩ মে, ১৯৭৬), সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিলুপ্তি, সংবিধানকে ইসলামিকরণ, পররাষ্ট্রনীতিতে সৌদী আরবসহ ইসলামি উম্মাহর সঙ্গে সম্পর্কের ঊষ্ণতা, কালক্রমে গোলাম আজমের ব্যক্তিগত ও দলগত পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার জন্য উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর প্রবেশ ও পরবর্তী পর্যায়ে হরকাতুল জিহাদ, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ ও বিভিন্ন নামে বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রাদুর্ভাব একই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর ছাড়া কিছু নয় এবং এটা সম্্‌ভব করেছে দুই সামরিক শাসকের বাংলাদেশ রাজনীতির    ডি-সেকুøইলারাইজেশন নীতির চতুর প্রয়োগ। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ অবদান যদি হয় রাজনীতির মধ্যে ও রাষ্ট্রনীতির মধ্যে সেকুøলারিজমের প্রতিষ্ঠা, তাহলে সামরিক শাসকদের প্রবর্তিত বিপরীত ধারার রাজনীতির বড়ো কৃতিত্ব (!) হলো সেকুøলারিজমের বিপরীত ধর্মসাম্প্রদায়িক ভাবধারাকে এক সমশক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা।
প্রসঙ্গত এটাও মনে রাখা দরকার যে, ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবের পর গোটা মুসলিম বিশ্বে তার একটা বড় প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তার আগেই ‘মুসলিম’ ধারায় চলে যায়। তুরস্ড়্গে, আলজিরিয়ায়, মিশরে, ইন্দোনেশিয়ায়, সৌদী আরবে, মালয়েশিয়ায়, এবং আমাদের বাংলাদেশে, জঙ্গি ইসলামের অভুøদয় প্রমাণ করে যে ইসলামি মৌলবাদের উত্থানের পিছনে ইতিহাসের একটা গতি ও শক্তি কাজ করছে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক শক্তি, মাদ্‌রাসাভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষার অভিন্নতা, সেই শিক্ষার মৌলিক ও অনপনেয় সঙ্কীর্ণতা, ইহুদিদের স্বার্থে অ্যাংলো-আমেরিকান যোগসাজসে ইসরাইল রাষ্ট্রের পত্তন, ইসরাইলের সামরিক শক্তির কাছে পরাজিত-পর্যুদস্ত ফিলিস্তিন, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার একচোখানীতি, বোমা-গ্রেনেডসহ সব ধরনের মারণাস্ত্রের সহজ প্রাপ্যতা, ইসলামে জেহাদের মহিমা ও শাহাদতের গরিমা, অধিকাংশ মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রে রাজতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্রের প্রবল উপস্থিতি, অবিকশিত বা অবরুদ্ধ গণতন্ত্র (বাংলাদেশ), সব কিছুর সমন্বয়ে এক দিকে যেমন মানুষ ধর্মমুখী হয়েছে; ইহজাগতিকতার বোধ দুর্বল হয়েছে; অন্যদিকে আবার বিক্ষুব্ধ যুবমানস সশস্ত্র উত্থানের পথে ধাবিত হয়েছে। ইসলামের সাম্যচেতনা পরাজিত হয়েছে ব্যাপক ও অপ্রতিহত বৈষম্যের কাছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকার কথাও এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখা প্রয়োজন। ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামি নীতির উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকে খুবই সন্দেহের চোখে দেখেছে। ইরাক-ইরান সংঘর্ষে আমেরিকা ইরাকের সমর্থনে তাকে রণসজ্জায় সজ্জিত করেছে। একদিন ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকেই শত্রুপক্ষ বিবেচনা করতে হবে। সেটা আমেরিকার হিসাবের বাইরে ছিল। আফগানিস্তানের রুশ-সাহায্যপুষ্ট সরকারের পতন ছিল আমেরিকার জন্য অত্যন্ত জরুরি কাজ। ওসামা বিন লাদেনকে এজন্য আমেরিকা কাবুল সরকারের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে বুদ্ধি-পরামর্শ-সহায়তা দিয়ে লড়াইয়ে নামিয়েছে। কাবুল সরকারের পতন, সোভিয়েত বাহিনীর বিদায়ের মধ্য দিয়ে এই আশুলক্ষ্য যদিও অর্জিত হলো, কিন্তু কাবুলের নতুন তালেবানি সরকারকে মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্্‌ভব হয়নি। যেহেতু বৈরী অবস্থানে চলে যাওয়া ওসামা বিন লাদেন কাবুলের দেয়া নিরাপত্তা লাভ করেছিলেন, আমেরিকা নিজের উদ্দেশ্য সাধনে যেমন সাদ্দামের ইরাককে রণসজ্জায় সজ্জিত করেছিল, একইভাবে কমিউনিস্টপন্থী কাবুল সরকারের পতন ঘটাতে কমিউনিস্ট বিরোধী মৌলবাদী শক্তির পাশে দাঁড়িয়েছিল। আফগানিস্তানে ইসলামের ধ্বজা উড্ডীন করবে এমন একদল জেহাদি সেনা সংগ্রহের মহান দায়িত্ব গ্রহণ করলো আমেরিকার সুহৃদ পাকিস্তান। আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর স্থাপিত হলো একগুচ্ছ মাদ্‌রাসা, একযোগে ধর্মশিক্ষা ও অস্ত্রশিক্ষার মাধ্যমে সেখানে জেহাদি আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে মুসলমান যুবকেরা। এই যুবকেরা জমায়েত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে এবং বাংলাদেশের মাদ্‌রাসা থেকেও।
বাংলাদেশের যেসব জেহাদি যুবক আফগানিস্তানে লড়াই করেছে, সেখানে তালেবান সরকারের পতনের পর তারা আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানেও দাঁড়াবার ঠাঁই পায়নি, সুতারাং তারা তাদের নতুন কর্মক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বাংলাদেশে। জোট সরকারে জামায়াতে ইসলামীর শরিকানা তাদের ভরসা যুগিয়েছে। আফগানিস্তানে তাদের পরাজয় তারা পুষিয়ে নিতে চেয়েছে বাংলাদেশে, যেখানে বিভিন্ন বিবেচনায় সরকার তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে বলে তাদের বিশ্বাস।
বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জামাআতুল মুজাহিদীনের গ্রেপ্তারকৃত সদস্যদের চিনিয়ে দেওয়া    আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও প্রচার-সাহিত্য, সিডি-ক্যাসেট থেকে প্রমাণ হয়, এই সন্ত্রাসী চক্র গঠিত হয়েছে মূলত দেশের মাদ্‌রাসার ছাত্রদের দ্বারা। একটি বিশেষ সুচিন্তিত প্রশিক্ষণের ধারায় এদেরকে তৈরি করা হয়েছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানার জন্য। সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মসজিদ ও মাদ্‌রাসাগুলোর মধ্য থেকে এরা বেছে নিতে পেরেছে এদের উদ্দেশ্যের সহায়ক মসজিদ ও মাদ্‌রাসাগুলো। অস্ত্রশিক্ষার জন্য এরা ব্যবহার করেছে বনজঙ্গল ও দুর্গম চর এলাকা। এদের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে, গোপনীয়তা রক্ষা করে। প্রশিক্ষণার্থীরা প্রকৃত নাম গোপন করে ভিন্ন নাম গ্রহণ করেছে, নিজেদের পরিচয় আড়াল করার জন্য। এরা অধিকাংশই বয়সে তরুণ এবং অনেকেই ছাত্রজীবনে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের সদস্য ছিল, পরে অধিকতর জঙ্গি জামাআতুল মুজাহিদীন-এর সদস্য হয়েছে। এরা প্রায় সবাই এসেছে দরিদ্র পরিবার থেকে, যা অধিকাংশ মাদ্‌রাসা ছাত্র সম্বন্ধে সত্য। জঙ্গি সংগঠনে আসার পর তারা নিয়মিত বেতন পেয়েছে, তাদের অর্থকষ্ট দূর হয়েছে। এদের আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত প্রচারসাহিত্য, সিডি-ক্যাসেট থেকে জানা যায়, এরা ওসামা বিন লাদেনের অনুসারী, এরা আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের আদর্শে বিশ্বাসী, ও-দেশে রুশ সরকারের সাহায্যপুষ্ট যে সাম্যবাদী সরকারকে ক্ষমতাচুøত করার যুদ্ধে তালেবান জয়ী হয়েছিল, সেটাকে তারা ধর্মযুদ্ধ মনে করে। সেই যুদ্ধের সৈনিক প্রস্তুত করার লক্ষ্যে মার্কিন সরকারের মদদে যে পাক-আফগান সীমান্ত বরাবর মাদ্‌রাসাগুচ্ছ গড়া হয়েছিল ও যে-উদ্যোগের অংশীদার ছিল পাকিস্তান সরকার, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশের অনেক মাদ্‌রাসা-শিক্ষিত তরুণ। কেউ কেউ অস্ত্র হাতে আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। কেউ কেউ লড়াইয়ে প্রাণ হারিয়েছে। শায়খ আবদুর রহমান সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি বারবার, বিভিন্ন পাসপোর্ট ব্যবহার করে, ভারতে ও পাকিস্তানে তো গিয়েছেনই, এমনকি আলকায়েদার সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইসলামি সন্ত্রাসের আন্তর্জাতিক রূপ এখন বোধহয় সবার কাছেই এক সন্দেহাতীত সত্য ও ভয়ংকর সত্য।
নাইন-ইলেভ্‌নের পর আমেরিকা ইসলামি মৌলবাদ ও মৌলবাদ-অনুপ্রাণিত সন্ত্রাস বিষয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে প্রথমে আফগানিস্তানে, তারপর ইরাকে যুদ্ধ পরিচালনা করে। দুটি দেশের উপর ব্যাপক ধ্বংস যুদ্ধ চালিয়ে, দুটি দেশের সরকারকে নিশ্চিহ্ন করেই থামেনি, পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক জেনারেল মোশারফকে বাধ্য করা হয়েছিল ও-দেশের মাদ্‌রাসাগুলোকে কঠোর নজরদারির মধ্যে আনতে। মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদও সে দেশের মসজিদ-মাদ্‌রাসায় মৌলবাদী তৎপরতা সম্বন্ধে সজাগ ছিলেন এবং জুমার নামাজে খুৎবার উপর এক ধরনের সেন্সরশিপ আরোপ করেছিলেন। আলজিরিয়া ও তুরস্ড়্গে সেনাবাহিনী রাষ্ট্র যাতে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে বিচুøত না হয় তার জন্য কড়া ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণের পরিবর্তে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এক ধরনের আপোসকামী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। বিভিন্ন সরকারের আনুকূল্য পেয়েই প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদের সমর্থকরা স্থান করে নিয়েছে। মৌলবাদীদের অর্থনৈতিক ভিত্তি খুবই মজবুত। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মধ্যেও এখন এদের সম্পর্কে দেখা যায় আপোসকামী মনোভাব।
এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে রাজনীতির গতিমুখ পরিবর্তন করা না হলে দেশে উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জয়যাত্রা শুরু হতো না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র আমূল পরিবর্তন করে একটি তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র এগিয়ে যেতে পারতো না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে আমাদের আজও পাকিস্তানের সঙ্গেই থাকতে হতো সেই পাঞ্জাবি সামরিক শাসকদের দ্বারা শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার-নিপীড়নের মধ্যে। আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থা কি তা-ও আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। পাকিস্তান এখন একটি লণ্ডভণ্ড দেশ। ধর্মের নাম করে মসজিদের ঢুকে নামাজরত মুসল্লিদেরও হত্যা করছে জঙ্গিরা। মানুষের জীবন সেখানে নিরাপদ নয়। ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য একেবারেই কল্যাণকর হতে পারে না,  পাকিস্তান তার বড় উদাহরণ।
বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান এবং তাদের কতিপয় সহযোগীর মৃতুøর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদী রাজনীতির ধারা শেষ হয়ে যায়নি। জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে তারা প্রকাশ্যে মাথা চাড়া দিতে পারছে না; কিন্তু এখনো সক্রিয় আছে। সবচেয়ে বড় কথা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রকাশ্য মদদদাতারা এখনো রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে। বিএনপি এবং জামায়াত ওই ধারায় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রেখেছে। তাই বাংলাদেশে সমাজ প্রগতির পশ্চাৎমুখী ধারাকে আবার বিপরীতমুখী করাটা মোটেও সহজ কাজ নয়। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায়-  অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে একাত্তরের মতো একটি বড় গণজাগরণ ঘটাতে হবে। গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক-সাংস্ড়্গৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। উন্নত ও স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক চেতনা এবং গণতান্ত্রিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে রাষ্ট্রের সকল স্তরে, প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে গণতন্ত্রের রক্ত সঞ্চালন করতে পারলেই দেশে সমাজ-প্রগতির ধারা সঠিক পথে প্রবাহিত হবে। নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবর্তমানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে গভীর অন্যায় ও অসঙ্গতি মানুষে মানুষে ব্যবধান সৃষ্টি করে, সেই সামাজিক ব্যাধির প্রতিকার ছাড়া জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা প্রতিহত করা সম্্‌ভব হবে না। শেষের কথাগুলো বলতে পারলাম সহজেই। আমার মতো অনেকেই বলেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো কে বলবে এখন। হতাশ আমরা হবো না। নেতৃত্ব অবশ্যই উঠে আসবে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্য থেকে। রাজনীতিকদের অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর মতো দেশপ্রেমিক হতে হবে।
০৪ জুন ২০১২