মোকাবেলায় প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম
মোনায়েম সরকারবাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একঝাঁক স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে- যার অপর নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতার দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রাম এবং সবশেষে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, মূল্যবোধ ও আদর্শকেই আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে মনে করি।
পৃথিবীর সব স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীই কতগুলো স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শকে সামনে রেখেই জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে লড়াই-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। আমাদের সেই আদর্শ ছিল- স্বশাসন, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্ড়্গৃতিক- তথা সার্বিক মুক্তি। বাংলাদেশের সংগ্রাম তাই একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ’৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। শুধু একটি পতাকার পরিবর্তনের জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। পাকিস্তান যে মতাদর্শ নিয়ে সাম্প্র্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং সামরিক স্বৈরশাসনের ধারায় চলেছিল, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। শত বছরের ধারাবাহিকতায় ও বহু গণসংগ্রামে অসংখ্য মানুষের আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন, আদর্শ এবং লক্ষ্যগুলো ধীরে ধীরে দানা বেঁধে সৃষ্টি হয় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মূলধারার রাজনৈতিক শক্তির- যাকে আমরা বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি হিসেবে জানি।
আমরা স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রম করছি। কিন্তু সেই চেতনা, স্বপ্ন বা আদর্শ আজ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জিত হয়নি। এখনও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী একটি মৌলবাদী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কাছে আমাদের মূলধারা তথা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতি বার বার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মূলধারার চেতনার পক্ষের শক্তি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে অর্জিত বিজয়কে সংহত করতে পারছে না। আমাদের জাতীয় জীবনে নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় ট্রাজেডি এবং ক্ষত। স্বাধীনতার এই চার দশক পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক দলগুলোর আত্মজিজ্ঞাসার সময় এসেছে। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মত ও পথ নিয়ে নানা বিভ্রান্তির ফলে বহু রক্তক্ষরণ হয়েছে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে, সশস্ত্র বিপ্লবের নামে, কখনো বা নকশালবাড়ি আন্দোলনের নামে। কেন তারা সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না? কেন তারা সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন-সাধ পূরণ করতে পারছে না? কেন অশুভ রাজনীতির অবসান হচ্ছে না? এর জন্য এদেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মুক্তিকামী মানুষকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে? যে সব দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বার বার মূলধারার রাজনীতিকে ক্ষত-বিক্ষত করছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে আর কত সময় লাগবে?
ধর্মাশ্রয়ী বৈষমম্যমূলক সংকীর্ণ পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট রাজনীতির উন্মেষ
আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক ভাবধারাপুষ্ট রাজনীতির শিকড় প্রোথিত আছে অতীতের গভীরে, ভারত-বিভাগকালে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালির ওপর একটি বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা জারি রেখেছিল। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অর্থনৈতিক বরাদ্দের প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালিকে সমানুপাতিক ন্যায্য পাওনা থেকে বরাবর বঞ্চিত করেছে পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলো। বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ করেছে বাঙালি জনগোষ্ঠী, সংগ্রাম করেছে একটি বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
সংস্ড়্গৃতির প্রশ্নেও বাঙালির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত আত্মপরিচয় বিকাশের অন্তরায় হিসেবে সক্রিয় থেকেছে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। পাকিস্তানি মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশ হিসেবে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা ও দাবি ছিল বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালির এই ন্যায্য দাবিকে কখনো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, কখনো রাজনৈতিক ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে অবজ্ঞা করেছে। বাঙালির এই জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাকে পাকিস্তানের ইসলামি চেতনা বিরোধী ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে দাবিয়ে রাখার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত পাঞ্জাবি শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যে-কোনো ন্যায্য গণতান্ত্রিক দাবিকেই ওরা ‘ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তা নামঞ্জুর করার অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী পন্থা অবলম্বন করেছে। স্বভাবতই বাঙালি তার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ ইতিহাসবোধ থেকেই ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির বিপরীতে সেকুøলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষাবলম্বন করেছে। ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে ব্যক্তিজীবনের একান্ত অঙ্গনে নিরাপদ রাখাই উত্তম মনে করেছে। ধর্ম ও রাজনীতি- উভয়ের জন্যই তা মঙ্গলজনক মনে করেছে বাঙালি জনগোষ্ঠী।
পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্ড়্গৃতিক কোনো আকাঙ্ক্ষার প্রতিই যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেনি। ফলে পাকিস্তানি জমানার প্রায় পুরো সময়টাই বাঙালি তার ন্যায্য আকাঙ্ক্ষা ও দাবি বাস্তবায়নের সংগ্রামে মুখর ছিল। তিক্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্ড়্গৃতিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বাঙালির ভেতর জাতিগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্ড়্গৃতিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে। এটা কোনো ইতিহাসবিচ্ছিন্ন বিমূর্ত ধারণার বিষয় নয়। এইসব পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বাঙালি। ছিনিয়ে আনে নির্বাচনী বিজয়। বাঙালি জাতির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ। তাই সত্তরের নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ার নিয়মতান্ত্রিক পথ প্রশস্ত করে। কিন্তু সেই প্রশস্ত পথে ফের কাঁটা বিছিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী। বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। পাকিস্তানপ্রেমী ধর্মবাদীদের পরাজয় ঘটে। কিন্তু এই কুচক্রীরা তাদের পরাজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভুøদয় সহজে মেনে নিতে পারেনি। সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বার বার আক্রমণের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। ষড়যন্ত্র-খুন-হত্যা ও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধের সব উপাত্ত-উপাদান ও অঙ্গীকার ধ্বংস করার অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। দেশি-বিদেশি সেই পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্রের নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়াটা আজ আমাদের ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশে পরিণত হয়েছে।
পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির পুনঃপ্রবেশ
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতোদ্যম না হয়ে বরং দেশি-বিদেশি চক্র বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র নতুন করে শুরু করে। পরাজিত পাকিস্তানি ও তাদের মিত্রদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু আত্মগোপনে থাকা জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগীরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য তৎপরতা চালায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকেও তখন ঐক্যবদ্ধ রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়নি। উল্টো স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল এবং মেধাবী বলে পরিচিত একটি অংশ মূল দল থেকে বেরিয়ে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ ্লোগান দিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ গঠন করে। তীব্র মুজিববিরোধী ভূমিকা নিয়ে চটকদার সব বক্তব্য দিয়ে তারা যে হটকারী রাজনীতি শুরু করে তাতে দেশের তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ বিভ্রান্ত হয়েছে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক দলগুলোও স্বাধীন দেশে সরকার বিরোধিতা করার মঞ্চ পেয়ে যায়। জাসদ তৈরি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে দুর্বল করার একটি ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ। তাছাড়া পাকিস্তান ফেরৎ সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীতে আত্মীকরণ করাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থের টানাপড়নের কারণে সেনাবাহিনীর ভেতরেও দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদের অনুকূলে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসারদের কেউ কেউ পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে হাত মেলায়।
একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কঠিন কাজ, অন্যদিকে ঘরে-বাইরে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে সরকারের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং আত্মত্যাগের যে মনোভাব তখন মুক্তিযুদ্ধ জয়ী রাজনৈতিক নেতৃত্বের দেখানো প্রয়োজন ছিল, তা দেখাতে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে সব সময়ই ছিল প্রগতি-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি স্বাধীন দেশে ফিরে আসার পর মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুজিবনগর সরকার নিয়ে অসন্তষ্ট ছিল তারা বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পায় এবং এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করতেও সক্ষম হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের মতো পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দূরত্ব তৈরিতে সফল হয় সেই পরিচিত চক্র।
মওলানা ভাসানী এবং নবগঠিত জাসদ নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। জাসদের মিলিট্যান্ট অঙ্গ সংগঠন গণবাহিনী এবং সিরাজ সিকদার-হক-তোয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন প্রমুখের নেতৃত্বে পরিচালিত উগ্র বামপন্থী গোপন সশস্ত্র সংগঠনগুলো- যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল- দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা ও অস্ত্র লুট, পাটের গুদামে অগ্নিকাণ্ড, ব্যাংক লুট, আওয়ামী লীগের ৫-৬ জন সংসদ সদস্যসহ জেলা পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতাকে গুলি করে হত্যা করাসহ নানা অন্তর্ঘাত চলতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সরকারকে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়, গ্রহণ করতে হয় কিছু নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা। বন্যায় ফসলহানি, প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রমূলক ‘খাদ্য রাজনীতি’র কারণে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মৃতুø হয় কয়েক হাজার মানুষের।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে গঠন করেন জাতীয় দল- বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল। চারটি মাত্র সংবাদপত্র রেখে বাকিগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এক ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক শাসন ব্যবস্থা চালু করায় গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ দিনের যে উজ্জ্বল ঐতিহ্য তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা ্লান হয়। সব মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে একটি ‘ভোলাটাইল’ অবস্থা তৈরি হয় এবং পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন বিপথগামী কিছু সেনাসদস্যদের হাতে। অবশ্য মাত্র কয়েকজন অপরিণামদর্শী, মাথা গরম সামরিক অফিসার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলেন বলে মনে করলে ভুল করা হবে। হত্যাকারীদের পেছনে ছিল দেশি-বিদেশি প্রভাবশালী শক্তিগুলোর প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমর্থন ও সহযোগিতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী দেশপ্রেমিক অভিজ্ঞ নেতাদের বাঁচিয়ে রেখে ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে না, এই অনুভব থেকে জেলখানায় হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং এম· মনসুর আলীকে।
হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে, বন্দুকের জোরে, বেআইনি সরকার প্রতিষ্ঠা করে, দেশকে সামরিক আইনের আওতায় নিয়ে এসে, সামরিক ফরমান দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ধারাসম্পন্ন পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য বদল করে পাকিস্তানি রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন করা হয়। শুরুতে শিখণ্ডি হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে পরিচিত খোন্দকার মোশতাক আহমদকে সামনে রাখা হয়েছিল মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এরপর ক্ষমতা গ্রহণ করে জিয়াউর রহমান প্রথমে যে কাজটি করলেন তা হচ্ছে দালাল আইনে সাড়ে সাত শ’র মতো অপরাধীর সাজা হয়েছিল তাদের মুক্ত করে দেওয়া। একই সঙ্গে তিনি দালাল আইনটিও বাতিল করে দেন। ১৯৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়া সংবিধান থেকে তা তুলে দিয়ে জামায়াত-মুসলিম লীগের মতো স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোকে রাজনীতি করার লাইসেন্স দিলেন। সংবিধানের মূল চালিকাশক্তি এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম চেতনা ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে দিলেন।
জেনারেল জিয়া একাত্তরের স্বীকৃত রাজাকার শাহ আজিজ, আবদুল আলীম, মাওলানা মান্নানকে বানালেন মন্ত্রী। ঘাতক শিরোমণি গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে এসে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেন। একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু বাঙালি সেনা অফিসার ছিল, যারা পাকিস্তানের হয়ে বাঙালি নিধনে শামিল হয়েছিল। এদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে বদলি হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যায় এবং পরে প্রত্যার্পিত হয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসে। বেশ কয়েকজন ১৬ ডিসেম্বরের পর এদেশে যুদ্ধবন্দী হয়ে পড়ে। এদের কাউকেই বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে আর ফেরত নেননি। বঙ্গবন্ধুর মৃতুøর পর এ রকম চৌদ্দজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে জিয়া পুলিশ বাহিনীতে আত্মীকরণ করেন।
পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় ও সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবার জন্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা শুরু করলো পূর্ণোদ্যমে। জিয়াউর রহমান একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবিধানকে পাকিস্তানের চেয়েও বেশি ধর্মীয়করণ করে দেশের রাজনীতিতে বিভেদের ধারাকে পোক্ত করেছেন। তার মৃতুøর পর আরেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিলেন একই লক্ষ্যে- আর সেটা হলো নিজের গণভিত্তি বাড়ানো এবং সব অপকর্মকে বৈধতা দেওয়া। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে দেশটাকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের দিকে এগিয়ে দিলেন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার বিষয় হলো, রাষ্ট্রধর্ম করেও কিন্তু এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলেন না। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, রাষ্ট্রধর্ম করে এরশাদের গণভিত্তি পোক্ত হয়নি, জনপ্রিয়তা বাড়েনি। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহারের সাথে সাথে এরশাদ রাজনীতিতে পীরতন্ত্রকেও উৎসাহিত করেছেন। তিনি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবহার করে বিভিন্ন পীরের দরবারে গিয়েছেন এবং এসব পীরের উপদেশ প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রচার করতেন।
এরশাদের পতনের পর প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী দল নির্বাচনী কৌশল হিসেবে নগ্নভাবে ধর্ম ও ভারতবিরোধিতাকে কাজে লাগালো। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার এমনই নোংরা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলো যে, ‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ধর্ম চলে যাবে, মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে, দেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত হবে’- ইত্যাদি অপপ্রচার জোরেশোরে চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগকে ওই নির্বাচনে হারানোর জন্য দেশের বাইরে থেকেও যে ষড়যন্ত্র ছিল, সে তথ্যও এখন নানাভাবে পাওয়া যাচ্ছে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, নানা ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তারা সফল হয়েছিল, নির্বাচনে জিতেছিল। যদিও ’৯১-এর নির্বাচনেও ভোট বেশি পেয়েছিল আওয়ামী লীগ কিন্তু আসন বেশি পেয়েছিল বিএনপি। ক্ষমতাসীন হয়েও বিএনপি রাজনীতিতে-রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানে- ধর্মের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছিল। সামাজিক পরিমণ্ডলে ধর্মের ব্যবহার এতটাই তীব্র হয়ে উঠলো যে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার অধিকারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগও ধর্মের বিষয়টিকে স্পর্শকাতর বিবেচনা করে নমনীয় ও আপসমূলক নীতি অবলম্বন করতে বাধ্য হলো। ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় এবং বিরোধী প্রচারণার জবাবে- তাদের রাজনৈতিক আচার-আচরণেও ধর্মীয় রীতি-নীতি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেল। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধারার রাজনীতি ধর্মভিত্তিক ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কাছে কিছুটা যেন আত্মসমর্পণ করলো।
জিয়ার আনুকূল্য ধন্য স্বাধীনতাবিরোধী চক্র
বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী ধর্মীয় রাজনীতিকে সামাজিক ভিত্তি দিয়েছেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তার হাত ধরেই জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে। জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী ছিল। মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করার জন্য রাজাকার-আলবদর-আলসামশ বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করেছিল। বাংলাদেশের পথঘাট ও মুক্তিকামী জনতার বাড়িঘর চেনাতে পাক-হানাদার বাহিনীর গাইড হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ৩০ লাখ বাঙালি নিধনে, এক কোটির ওপর দেশছাড়া আরও কয়েক কোটিকে ঘরবাড়িছাড়া, তিন লাখ নারীকে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন, কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুন্ঠন ও হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালানো-পোড়ানোতে যারা পাকবাহিনীর চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। গত ৫ অক্টোবর ২০১১ পাকিস্তানের ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ‘ডেইলি টাইমস’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে উল্লিখিত বিষয়গুলোকে কবুল করে নিয়ে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী যতটা না হিংস্র ছিল, ওই উগ্র গোষ্ঠীটি গণহত্যায় তাদের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে দলের নেতারা পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য মুসলিম দেশগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগকারী যুদ্ধাপরাধীরা সাধারণ ক্ষমার আওতা বহির্ভূত ছিল। প্রায় ১১ হাজার দালাল-রাজাকার এসব গুরুতর অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করে। ফলে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী জেল থেকে বেরিয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ইসলামী জলসায় ্লোগান ওঠে, ‘তাওয়াব ভাই-তাওয়াব ভাই, চাঁদতারা মার্কা পতাকা চাই’ (ইত্তেফাক, ৮ মার্চ ১৯৭৬)। সে দিনের উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তাওয়াবের বদান্যতায় ওই জলসায় জামায়াত-আলবদর-রাজাকারদের ছিল স্বাধীনতার পর প্রথম প্রকাশ্য আত্মপ্রকাশ। ওই মজলিসে যে দাবিগুলো উত্থাপন করা হয় তার মধ্যে ছিল- দেশের পতাকা বদলাতে হবে, নতুন জাতীয় সংগীত চাই, দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে হবে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার ভেঙে দিতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত রাজাকারদের স্মরণে মিনার নির্মাণ করতে হবে। ধৃষ্টতা আর কাকে বলে! কিন্তু যারা এই ধৃষ্টতা দেখিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান কোনো ব্যবস্থা নেননি, কোনো কথা বলেননি। উল্টো যেন এদের আবদারের সমর্থনেই জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছাঁটাই করেন। ধর্মের নামে দল গঠনের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। জামায়াতে ইসলামীর মতো স্বাধীনতাবিরোধী ধর্ম ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার অস্বীকার করেন।
এখানেই শেষ নয়। জিয়াউর রহমান সেনা বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বে থেকেই সেনা ছাউনিতে বসে জন্ম দেন বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সুবিধাবাদী লোকরা ওই দলে যোগ দিতে থাকে। যে দলটির মোকাবিলায় বিএনপির আত্মপ্রকাশ, সেই নেতৃত্বশূন্য মাথাকাটা আওয়ামী লীগের তখন ঘোর অমানিশা। সে দলের সুযোগসন্ধানী দু’চারজন আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অর্থ ও পদের লোভে বিএনপিতে ঢুকে পড়ে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের আদর্শবিরোধী অবস্থান। আওয়ামী লীগের আদর্শ মানে যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর আদর্শ, এটা বুঝেই বিএনপি তার বিপরীতে অবস্থান নেয়। অর্থাৎ আকস্মিকভাবে নয়, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে শুরুতেই অবস্থান নেয় এবং এখনো বিএনপি সেই রাজনীতিই করছে।
বিশ্বাসঘাতক খোন্দকার মোশতাকের জারি করা করা ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’কে আইনে পরিণত করেন জিয়াউর রহমান। ওই আইনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীতে পাকিস্তানি ভূতেরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে জঙ্গিবাদের উত্থানের পথ পরিষ্ড়্গার করে। গোলাম আযমের মতো কুখ্যাত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গণশত্রু ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশে আনা হয়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত অবৈধ নির্বাচনকে এক ব্যক্তি কমিশনের প্রধান হিসেবে বৈধ বলে রায় দেন যে বিচারক, সেই বিচারপতি সাত্তারকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। বসানো হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী খাঁটি মুসলিম লীগাররা বিএনপিতে ঠাঁই পেয়ে যান। শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে রোখার জন্য ‘বাংলাদেশি’ নামক একটি নতুন জাতীয়তার তত্ত্ব তুলে ধরেন। যার কোনো ইতিহাস নেই, ঐতিহ্য নেই, নেই কোনো যৌক্তিক ভিত্তি। নাগরিকত্ব ও জাতীয়তাকে এক মনে করে তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ও জাতির পিতা স্বীকার না করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক ও প্রধান নায়ক বানানোর অপচেষ্টা শুরু হয়।
বিএনপি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সুচতুরভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ভূমিকা পালন করে আসছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন খালেদা জিয়ার সরকার দেশের বরেণ্য ২৪ বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে। পরবর্তীসময়ে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত নিজামী, মুজাহিদ ও আবদুল আলীমকে মন্ত্রী করা হয়। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে উপদেষ্টা করা হয়। আজ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে, তখন এই বিচারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে বিএনপি। মুখোশের আড়ালে বিএনপির প্রকৃত মুখটা দেশবাসী দেখতে পারছে।
ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও বিএনপি
বিএনপির রাজনীতির প্রাণ-ভোমরা হলো ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পাকিস্তানঘেঁষা সাম্প্রদায়িক সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রধান ছাতা হিসেবে বিএনপি সব সময়ই অন্যদের ছায়া যুগিয়েছে। এমনকি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার হাত দিয়ে এদেশে সৎ ত্যাগী মানুষদের রাজনীতি করার, রাজনীতির মঞ্চ থেকে শাসন ক্ষমতায় আসার যে সংস্ড়্গৃতি- তারও মূলোচ্ছেদ করা হয়েছে। ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ধুয়া তুলে দেশের রাজনীতিকে সন্ত্রাস ও কালো টাকার ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। জিয়াউর রহমানের নীলনকশা অনুযায়ী প্রকৃত ও সৎ রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি ডিফিকাল্ট (তার উক্তি- ও রিষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরপং ফরভভরপঁষঃ ভড়ৎ ঢ়ড়ষরঃরপরধহং) করে তোলা হয়। জেনারেল জিয়া সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে অর্থ ছড়িয়ে, ভয় ও লোভ দেখিয়ে অসৎ লোকদের এনে রাজনীতিতে জড়ো করে, তাদের দিয়ে দল গঠন করে, প্রকৃত রাজনীতিকদের রাজনীতির মাঠ থেকে হটিয়ে দিয়ে যে বিষবৃক্ষের চারা দেশের রাজনীতিতে রোপণ করেছিলেন, সেই চারাই আজ বড়ো হয়ে উঠেছে। দেশে পঁুজির অবাধ বিকাশের নামে ব্যাংকের দরোজা খুলে দেওয়া হয়েছিল নব্য ব্যবসায়ী লুটেরাদের জন্য, অনুগ্রহভোগীদের জন্য। রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। তাতে দেশে প্রকৃত শিল্পপতি, পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরি হয়নি। তৈরি হয়েছে লুটেরা শ্রেণী এবং লুটপাট ও বিদেশে টাকা পাচারের প্রবল ক্ষমতাশালী একটার পর একটা সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটগুলোর স্বার্থরক্ষা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবেই গড়ে তোলা হয়েছিল সমাজব্যবস্থার সর্বস্তরে এমনকি শিক্ষাঙ্গনেও শক্তিশালী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দেশের গণতান্ত্রিক ধারার যে সব দল ও সংগঠন রয়েছে সেই দেশপ্রেমিক শক্তি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সম্্ভাব্য সব কিছুই করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যাতে পুনরায় সংগঠিত হতে না পারে তার জন্য জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে সব ধরনের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগকে ভেঙে আলাদা দল গঠনেরও অপচেষ্টা করা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের দক্ষিণঘেঁষা প্রবীণ কিন্তু কিছুটা দুর্বল চিত্তের নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দিয়ে পৃথক আওয়ামী লীগ গঠনের কথা উল্লেখ করা যায়। আওয়ামী লীগের মধ্যে ডান-বামের দ্বন্দ্ব সব সময় ছিল। ডান পন্থার প্রতি যাদের ঝোঁক ছিল তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে সামরিক শাসকরা। অন্যদিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে মৌলবাদী ও সন্ত্রাসী লুটেরা গোষ্ঠীকে- যারা দেশে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের ধারাকে ব্যাহত করার জন্য সব ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু সময়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পরীক্ষিত বামপন্থীদের মধ্যেও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) জিয়াউর রহমানের ১৯-দফা কর্মসূচি ছেপে বিলি করেছে আর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) গেছে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রে মাটি কাটতে। অবশ্য তাদের ভ্রান্তি দূর হতে বেশি সময় লাগেনি।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা বলা হলে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব তা অস্বীকার করেন। কিন্তু হত্যা-কুøয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদল ও স্থায়ী করার প্রক্রিয়ায়ই যে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটির জন্ম সেটা অস্বীকার করা হবে কোন্ যুক্তি ও তথ্যের ওপর নির্ভর করে? আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া চলাকালে অনেকেই ঘাতকদের সঙ্গে জিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। হত্যা পরিকল্পনার কথা যে জিয়াউর রহমান জানতেন এবং তিনি যে তাদের এগিয়ে যেতে বলেছিলেন, তারও অনেক তথ্য-প্রমাণ এখন পাওয়া যাচ্ছে। ঘাতকদের কেউ কেউ বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের কাছেও এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দিয়েছে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, জিয়া হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান বেনিফিশিয়ারি। তিনি যদি ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত না থাকতেন তাহলে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েও কেন খুনিদের বিচারের সম্মুখীন না করে উল্টো তাদের বিচার থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং বিদেশি দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্ড়্গৃত করেছিলেন? জিয়া নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করলেও শাসনক্ষমতা হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ঠেলে দিয়েছেন। জিয়ার উত্তরসূরী হিসেবে খালেদা জিয়া তার দেখানো পথেই হেঁটেছেন। অনেক নাশকতা-সহিংসতার সঙ্গেই বিএনপির সংশ্লিষ্টতার কথা বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে। অথচ দুর্ভাগ্য, দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে বিএনপি এখনও একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল!
ছিয়াশির নির্বাচন ও বেগম খালেদা জিয়ার রহস্যময় আচরণ
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যার পর নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত সামরিক শাসক জিয়ার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার আগেই তিনি উচ্চাভিলাষী সামরিক সহকর্মীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। হত্যা-কুø ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি নতুন পথ ধরে এগুতে থাকে। এর আগেই অবশ্য আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা থেকে দলের সভানেত্রী নির্বাচন করা হয় বঙ্গবন্ধুর প্রবাসী কন্যা শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করায় ষড়যন্ত্রের রাজনীতির যারা বিশারদ তারা এটা বুঝতে পারে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হবে এবং দেশে মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতি শক্তি সঞ্চার করবে। পঁচাত্তর ও একাত্তরের ঘাতকদের সুদিন থাকবে না। বিপদ আঁচ করে তারা নতুন ছক কেটে, নতুন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। জিয়ার মৃতুøর পর কিছুদিন বিচারপতি সাত্তার বিএনপির এক নড়বড়ে সরকার পরিচালনা করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তাকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল এরশাদ। এরশাদের ক্ষমতা দখল এবং খালেদা জিয়াকে বিএনপির প্রধান বানানো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিরই পরিকল্পিত ছক।
মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশের রাজনীতি যাতে ফিরতে না পারে অর্থাৎ পাকিস্তানি ধারার রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিলেন এরশাদ। দেশের মানুষ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ সমর্থন করেনি বলে শুরু থেকেই এরশাদকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। ’৮৩-র মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন এরশাদকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানায়। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য ড· কামাল হোসেনের বাসায় বৈঠকরত ৩৪ জন জাতীয় নেতাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে ভয় দেখানো হয়। নিপীড়ন চালালে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধবে না বলে এরশাদ ভুল হিসাব করেছিলেন। দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল সবাই এরশাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে রাজপথে নামে। গড়ে ওঠে প্রবল আন্দোলন। এই আন্দোলনে যুক্ত হতে থাকে সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে চাপের মুখে এরশাদ ১৯৮৬ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। এই নির্বাচনকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে সেই সময়ে ১৫ ও ৭ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিসহ কয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দল এরশাদের ষড়যন্ত্রকেই সফল হতে সহায়তা করে। কেননা এরশাদ চাইছিলেন যে-কোনো মূল্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ভাঙ্গতে। তার বিশ্বাস ছিল, বিভক্ত রাজনৈতিক শক্তি তার বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। বাস্তবক্ষেত্রে ঘটলোও তাই। বিএনপি যতটা না এরশাদের স্বৈশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তার চেয়ে বেশি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের চরিত্র হননে তৎপর হয়ে ওঠে। বিএনপি নেত্রীর এই আকস্মিক পিছটান সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। এর পুরো ফায়দা তোলেন এরশাদ। ঐক্য বিনষ্ট হওয়ায় এরশাদের বিরুদ্ধে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে নানা কারসাজি করে প্রশাসন, কালো টাকা, মিডিয়া কুøর মাধ্যমে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আদায় করে। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি যদি ১৫ দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে ’৮৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতো, তাহলে নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হতে পারতো।
ছিয়াশির নির্বাচনে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কেন শেষ মুহূর্তে পিঠটান দিয়েছিলেন তা সাধারণ মানুষের কাছে এক অপার বিস্ময়। তবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের রাজনৈতিক সংকটের মুখে নিক্ষেপ করে তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কলঙ্ক আরোপের মাধ্যমে নিজের আপোসহীন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই বেগম খালেদা জিয়া সেদিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন। এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী- যারা বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে নিতে চায় না- তারাও কলকাঠি নেড়েছে বলে মনে করার কারণ আছে। বেগম জিয়াকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্যই জিয়া-হত্যাকাণ্ডের পর তাকে ক্যান্টনমেন্ট ও গুলশানের বাড়িসহ নানা ধরনের ‘ভেট’ দেওয়া হয়েছিল। বেগম জিয়া সেগুলো সানন্দচিত্তে গ্রহণ করেছেন। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আপোসহীনতার সিলমোহর লাগালেও এরশাদের দয়ার দান তিনি ফিরিয়ে দেননি। এমনকি অনেক পরেও তা ফিরিয়ে দিতে ওজর-আপত্তি ও টালবাহান করেছেন।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির ভূমিকা ছিল খুবই রহস্যজনক। স্বামীর হত্যাকাণ্ডের এক ধরনের বেনিফিশিয়ারি হয়ে ক্যান্টনমেন্টেই বাড়িঘরের মালিকানা পেয়েছেন এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বাস করেছেন। যে এরশাদ বন্দুকের জোরে বিএনপি সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করেছেন বেগম জিয়া তার কাছ থেকেই নানা সরকারি অনুগ্রহ গ্রহণ ও ভোগ করেছেন। বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে যখন জেনারেল এরশাদ সামরিক অভুøত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা থেকে হটান এবং বিএনপির অনেক নেতা ও মন্ত্রীকে জেলে ঢোকান, তখন বেগম জিয়া তার বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করেননি। বরং সম্পূর্ণ মৌন থেকে এরশাদের অপকর্মকে একটা সময় পর্যন্ত নীরব অনুমোদন দিয়েছেন বলা চলে।
আসলে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কুশিলবরা নেপথ্যে থেকে বেগম জিয়াকে ব্যবহার করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের ধারা যাতে বলবান হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে না পারে সেজন্য সামরিক ষড়যন্ত্রকারীদের বেসামরিক লেবাসে একটি দলের প্রয়োজন ছিল। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সেই দল হিসেবে কাজ করেছে। বেগম জিয়ার নিজের কোনো আদর্শিক রাজনৈতিক অবস্থান নেই, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এবং আওয়ামী লীগকে ঠেকানোর জন্য তাকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সুখ-সাচ্ছন্দ ও বিলাসী জীবনের নিশ্চয়তার বিনিময়ে তিনি রাজনীতির মঞ্চে অভিনয় করে যাচ্ছেন। বলা যায়, এই ক্ষেত্রে তিনি সফল।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে বেগম জিয়া ও বিএনপির ভূমিকা
১৯৯১ সালে নানা কারসাজি করে নির্বাচনে জিতে বিএনপির পক্ষ থেকে আস্ফালন করে বলা হয়েছিল, একশ’ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। কিন্তু পঁচাত্তরের বিয়োগান্ত ঘটনার ২১ বছরের মাথায় এসে ১৯৯৬ সালেই আওয়ামী লীগবিরোধী তথা মুক্তিযুদ্ধের ধারার রাজনীতির বিরোধী শক্তি একটা বড় হোঁচট খায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। কাজটা অবশ্যই খুব সহজ ছিল না। তারপরও আওয়ামী লীগ সরকার তখন অত্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আত্মস্বীকৃত খুনিদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে তড়িঘড়ি করে ফাঁসিতে ঝোলানোর পথে না গিয়ে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা পূরণ করতে কিছু মানুষকে যেনতেনভাবে মৃতুøদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করেনি শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু জেনারেল জিয়ার মৃতুøর পর সামরিক আদালতে তড়িঘড়ি করে ১৪ জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
দুঃখের বিষয় দেশের প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়া এতই লম্বা যে, পাঁচ বছরের মেয়াদকালে শেখ হাসিনার সরকার তা সম্পন্ন করতে পারেনি। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃতুøদণ্ডের আদেশ দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃতুøদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃতুøদণ্ড বহাল রেখে ৩ জনকে খালাস দেন। এরপর সরকার বদলের পর এই প্রক্রিয়া কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ওই সময় ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা হয়তো মনে করেছিলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনে তার দল আবার ভোটযুদ্ধে বিজয়ী হবে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শেষ করতে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের ফল আওয়ামী লীগের পক্ষে যায়নি। একদিকে আওয়ামী লীগ বিরোধী সর্বাত্মক অপপ্রচার, অন্যদিকে বাস্তবতা অনুধাবন করে কার্যকর কৌশল গ্রহণে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক চক্রের নীলনকশার নির্বাচনে এককদল হিসেবে বেশি ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ আসন সংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় বসে তাদের ‘আদর্শ’ মতোই বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নানা ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। হত্যা মামলার আপিল শুনানি নিয়ে জোট সরকার ক্রমাগত টালবাহানা করেছে। জোট সরকারের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ নেপথ্য থেকে কলকাঠি নাড়ায় একের পর এক বিচারপতি ওই মামলার শুনানি গ্রহণে বিব্রতবোধ করেছেন। এছাড়াও আপিল বিভাগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ না দিয়ে মামলাকে হিমঘরে পাঠানো হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার যে ওই মামলা শেষ করতে চায়নি, খুনিদের বিচারের মুখোমুখি হওয়াটা যে জোট সরকারের মনঃপূত ছিল না, এটা কারও না বোঝার কথা নয়। সঙ্গত কারণেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি বিএনপি-জামায়াত কৃতজ্ঞ এবং দুর্বল। এই খুনিচক্রের বদৌলতেই যে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির উত্থান।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগ্রহ বা প্রচেষ্টা বিএনপির মধ্যে কখনোই ছিল না। সে জন্যই নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী নেতৃত্বকে দুর্বল বা খতম করার প্রক্রিয়ায় তাদের অধিক মনোযোগ লক্ষ করা যায়। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামীগের সব শীর্ষনেতাকে হত্যার অপচেষ্টার সঙ্গেও বিএনপির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে হত্যার যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, এখন নানাভাবেই এটা জানা যাচ্ছে, ওই ঘটনায় বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও জড়িত ছিলেন। আক্রমণকারীদের রক্ষা করার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানা অপতৎপরতা চালিয়েছে। ওই গ্রেনেড হামলার দায়ও আওয়ামী লীগের ওপরই চাপিয়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন বেগম জিয়া থেকে শুরু করে বিএনপির শীর্ষ নেতারা। শুধু শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনাই নয়, ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচার, আহসান উল্লাহ মাস্টার, শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার দায় বিএনপি সব সময়ই আওয়ামী লীগের ওপর চাপাতে চেয়েছে। এসব ঘটনাসম্পর্কিত মামলাগুলোকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে, আওয়ামী লীগকে ফাঁসাতে নানা অসৎ ফন্দিফিকির করেছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের বিপুল বিজয় স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা এটাকে সহজভাবে মেনে নিতেও পারেনি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, নির্বাচনে বিএনপি কোনো সময় হারতে পারে না। বিএনপি সব সময় থাকবে শাসক দলের মুকুট পরে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করায় বিএনপি নেতৃত্ব চরম অস্বস্তিতে আছে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য তাদের নেই। এর মধ্যেই তারা সরকার পতনের লক্ষ্যে বিভিন্ন হিংসাত্মক কর্মসূচি পালন করছে। জামায়াতসহ বিভিন্ন উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কর্মীদের দিয়ে নাশকতামূলক কর্মসূচি পালন করছে। বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা বিদ্রোহের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার পক্ষে উস্ড়্গানি দিচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বিএনপি শুরুর দিকে কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিলেও সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রকাশ্যেই নিজামী-মুজাহিদদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং কার্যত তিনি বিচারেরও বিরোধিতা করেছেন। সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটা বলা হয়ে থাকে যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ বানচাল করাই বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। প্রথমে মানুষ এটা সেভাবে বিশ্বাস না করলেও এখন বিভিন্ন সমাবেশে বেগম জিয়ার প্রকাশ্য বক্তব্যের পর মানুষের কাছে তার অবস্থান ও মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে। বিএনপি এখন মূলত জামায়াতনির্ভর দলে পরিণত হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াত জোটের রোডমার্চ উপলক্ষে আয়োজিত সিলেট, বগুড়া ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন সমাবেশে জামায়াতের শক্তি প্রদর্শন সেটাই প্রমাণ করে। বিএনপিতে যারা নিজেদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে দাবি করেন, তারা কি বেগম জিয়ার এই দাবির সঙ্গে একমত যে, নিজামী-মুজাহিদরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী নয়? গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদরা একাত্তরে কোন্ পক্ষ অবলম্বন করে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে কাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল? বেগম জিয়া ও পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা একাত্তরের স্মৃতি ভুলে যেতে পারেন, কিন্তু স্বজনহারা কোটি কোটি বাঙালির পক্ষে কি তা ভুলে যাওয়া বা ভুলে থাকা সম্্ভব?
গণতন্ত্র ও প্রগতিবিরোধী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রুখতে হবে
যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে বিএনপি কেবল সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে বলে মনে করলে ভুল করা হবে। বিএনপি বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচুøত করতে চায়। কারণ, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদেরও বাঁচানো সম্্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং সরকার কি বিএনপির এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করবে, নাকি এটাকে মামুলি বিষয় বলে উপেক্ষা করবে?
বিএনপির এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করার কোনো বিকল্প বর্তমান সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। এটা শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্ন নয়, দেশে নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি চালু রাখার স্বার্থেই করতে হবে। আর তা না হলে শুধু আওয়ামী লীগেরই পরাজয় হবে না, পরাজয় ঘটবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের, সকল শুভ শক্তির।
মনে রাখা দরকার যে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার এই চার দশকে দুটি প্রধান ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটি পাকিস্তানি আমলের রাজনৈতিক ধারা, অন্যটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সিভিল মিলিটারি বুøরোক্রেসি, নব্যধনী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি গণবিরোধী চক্র গড়ে ওঠে। এই চক্রের পেছনে শক্তি জোগায় সৌদি পেট্রো ডলার, পাকিস্তানি সামরিক চক্র এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এই শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের বহু ভুলত্রুটি থাকা সত্ত্বেও একটি শক্ত অবস্থান নিয়ে আছে আওয়ামী লীগ ও বামধারার কয়েকটি দল অর্থাৎ চৌদ্দদলীয় জোট। জনসমর্থনেই আওয়ামী লীগ ওই জোটের শক্তির প্রধান উৎস।
গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কখনও চায়নি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসুক। আওয়ামী লীগের গণসম্পৃক্ততা, অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্রই সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দলটির প্রতি বিমুখ করে রেখেছে। এমনকি আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা ঠেকানোর জন্য তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিএনপি-জাতীয় পার্টির জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতার শত্রুদের ক্ষমতায় এনেছে। স্বাধীনতার আদর্শ ও চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পাহারায় তারা দেশে একটি নব্যধনী শ্রেণী ও শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, কালো টাকাকে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিয়েছে। এসব কাজে তারা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগীয় মৌলবাদ ও পশ্চিমা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ও সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস বিশ্ব ব্যাংক আইএমএফ, ন্যাটো ও সিআইএ-র পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ কখনও একটি বামপন্থী বা সোশ্যালিস্ট দল ছিল না, ছিল একটি মাল্টিক্লাস লেফ্ট অফ সেন্টার পার্টি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দলটি এই চরিত্র বজায় রাখতে পারেনি। এই দলেও ক্রমশঃ কায়েমি স্বার্থবাদীদের ভিড় বাড়তে থাকে। ডানপন্থার দিকে, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপসের দিকে ঝোঁক বাড়তে থাকে। কখনও কখনও সহজে ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ইচ্ছা ও স্বার্থের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ আপস করেছে। কিন্তু পঞ্চাশ বছরের গণআন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী দল গণসম্পৃক্ততা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেনি। আওয়ামী লীগকে তাই ক্ষমতায় আসতে দিতে দেশের ওই চক্র, মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যযুগীয় মৌলবাদ এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সব সময়ই অনাগ্রহ এবং আপত্তি। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা ঠেকানো এবং তাদের স্বার্থরক্ষার বাহন হিসেবে তারা বিএনপিকেই বেছে নিয়েছে।
বার বার আক্রান্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি
একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এদেশে বোমা-গ্রেনেড-হত্যা-কুø-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগসহ তার মিত্ররা। আর এসবের প্রতিকারের জন্যও তাদেরকেই এককভাবে ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলায় হত্যা করা গেলে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গ মুখে আনার জন্য মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন সম্্ভব না হলে এই বিচার যেভাবে ঝুলে গিয়েছিল তা হয় ঝুলে থাকতো কিংবা কোনো কারসাজিতে খুনিদের অব্যাহতি দেওয়া হতো। ২০০৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হওয়ায় ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যার চূড়ান্ত বিচার সম্্ভব হয়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সম্মিলিত আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে ইনডেমনিটি বিলও বাতিল হতো না, মামলা করার পথও সুগম হতো না; বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও তার রায় ছিল সুদূরপরাহত। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগের ছোটখাটো ভুলত্রুটি নিয়ে যারা অতি সোচ্চার তাদের এই রাজনৈতিক বাস্তবতাটা বিবেচনায় রাখতে হবে। না হলে ভুল পথে হাঁটা হবে।
এদেশে এখন পর্যন্ত যত নাশকতা, বোমাবাজি, গ্রেনেড হামলা, জঙ্গি হামলা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার সব কটির শিকার হয়েছে- আওয়ামী লীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অন্য কোনো রাজনৈতিক-সাংস্ড়্গৃতিক সংগঠন, প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিবিদ, বাঙালি সংস্ড়্গৃতির ধারক ব্যক্তি, সংস্থা বা অনুষ্ঠান। এখন পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপি-জাতীয় পার্টি কিংবা অন্য কোনো মৌলবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি, দল বা সংস্থা কিংবা তাদের কোনো অনুষ্ঠানে কোনো রকম হামলা-খুন, বোমা-গ্রেনেড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেনি। ঢিলটা কে ছুঁড়ছে তা অনেক ক্ষেত্রে উদঘাটিত না হলেও ঢিলটা কার বা কাদের ওপর পড়ছে- তা দেখেও কিন্তু আমরা সহজেই বুঝতে পারি- কে বা কারা টার্গেট। আর এ ক্ষেত্রে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যে ঢিলটা কারা ছঁুড়ছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিই যে মৌলবাদী ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট চক্রের মূল টার্গেট- একথা কবুল করে নিতে বিরাট কোনো গবেষণার দরকার হয় না। বিএনপি সব হামলা, সব ষড়যন্ত্র ও নাশকতার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে, এসব ঘটনার তদন্ত ও বিচার কাজে বাধা সৃষ্টি করে অথবা মামলার তদন্ত ও বিচার কাজ ইচ্ছেমতো প্রভাবিত করে নিজেদের ষড়যন্ত্রকারীর দোসর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির প্রাণভোমরা এখন বিএনপি। আর তাদের ‘বি-টিম’ হিসেবে কাজ করা মৌলবাদী সংগঠনের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিস্তানপন্থী ভাবধারাপুষ্ট একটি মৌলবাদী ধর্মরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে বর্তমানে এক ডজনেরও বেশি ধর্মাশ্রয়ী দল ও গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে এবং তারা নানা নামে ও ছদ্মবেশে নিরন্তর অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই বিএনপি ও তাদের দোসরদের অপতৎপরতা সম্পর্কে সজাগ এবং সতর্ক থাকা, তাদের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে গণমানুষের অধিকার আদায় এবং সুষ্ঠুধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করাটা বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে চলা আওয়ামীবিরোধী তথা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণাকে অকার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার পরও আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের রাজনীতিতে ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করার নিরন্তর যে প্রচারণা সেই প্রচারণায় দেশের নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়েছে। তারা মনে করেছে, ‘আওয়ামী লীগ মানে হচ্ছে, দুঃশাসন, বিভীষিকা, হত্যা-খুন-লুটপাট। ভারতের কাছে দেশকে, দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দেওয়া। ইসলামের টুটি টিপে ধরা।’ পাকিস্তানি ভাবধারাপুষ্ট বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তিদের এই অপপ্রচার আওয়ামী লীগকে যে নানা সময়ে কোণঠাসা ও বিব্রত করে তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের অনেক মানুষই মোটামুটি এই ধারণায় বিশ্বাসী। এই অপবিশ্বাসের মূল উপড়ে ফেলার জন্য যে ধরনের মতাদর্শিক লড়াই চালানো দরকার তেমন কিছু খুব একটা চোখে পড়ে না। ক্ষমতায় গিয়েও দলের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বকে সুসংহত করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। প্রতিপক্ষ যেখানে প্রবল ও শক্তিশালী সেখানে যে দৃঢ়তা, সততা, নমনীয়তা ও উদারতা প্রয়োজন ছিল তা আওয়ামী লীগ দেখাতে পারেনি। এমনকি কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকা পালনকারী ছোট দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই চালানোর তেমন ধারাবাহিক উদ্যোগ ও আন্তরিকতা চোখে পড়েনি। বড়দলসুলভ অহমিকা আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে একগুঁয়ে নীতি-পদক্ষেপ আওয়ামী লীগকে আরও বেশি একা বানিয়ে ফেলেছে। এতে করে অনেক পরীক্ষিত মিত্রও নিষ্ত্র্নিয় হয়েছেন কিংবা ভিন্ন অবস্থানে চলে গেছেন। ’৮০-র দশকে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে বাকশাল গঠন ও ’৯০-এর দশকে ড· কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম গঠন আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করেছে। এরফলে ’৯১ ও ২০০১-এর নির্বাচনে বিএনপি-র বিজয় সহজতর করেছে।
প্রসঙ্গত আবদুর রাজ্জাক ও ড· কামাল হোসেনের কথাও উল্লেখ করা যায়। তারা দু’জনেই বঙ্গবন্ধুর স্নেহ এবং সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার দায়িত্ব আবদুর রাজ্জাককে এবং সংবিধান রচনায় ড· কামাল হোসেনের ওপর দায়িত্ব অর্পণ ছিল তাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থারই বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবদুর রাজ্জাক ও ড· কামাল হোসেন যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এতদসত্তেও ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শেখ হাসিনা ড· কামালকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করেছিলেন। এরশাদের পতনের পর ড· কামাল হোসেন আর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ড· কামাল হোসেনের রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকাও গঠনমূলক এবং ইতিবাচক ছিল না। সব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করাই যেন তার প্রধান রাজনীতি হয়ে দাঁড়ায়। ড· কামালের এই ভূমিকা অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন হয়েও এখন যে রাজনীতি করছেন তাতে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের ক্ষতি বৈ লাভ কিছু হচ্ছে না। তাছাড়া তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রীড়নক হয়েই আওয়ামী লীগের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গণফোরাম গঠন করেছিলেন এটা এখন নানাভাবে জানা যাচ্ছে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭১ সনে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরকে মোকাবেলা করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী কালপর্বে একটি প্রচারণা ছিল, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে হলে আর্মি ও আমেরিকা কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এই প্রচারণা আওয়ামী লীগের ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের প্রভাবিত করাটাই স্বাভাবিক। আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্্ভাবনা মাথায় রেখে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে তথা রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে বাদ দেয়ার নানা কূটচাল চেলে এসেছে। এই চক্রই সম্্ভবত ড· কামাল হোসেনকে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে এবং কামাল হোসেনও নিজেকে ক্ষমতার জন্য সবচেয়ে যোগ্য বিবেচনা করে গণফোরাম গঠন করেছিলেন। গণফোরামের সূচনাটা এতটাই ঢাকঢোল পিটিয়ে হয়েছিল যে, দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীদেরও অনেকে সেই সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। প্রধান অতিথির ভাষণে ড· মুহম্মদ ইউসূস স্বপ্নের পার্টির কথা বলেছিলেন। তা থেকে কারো কারো মনে হয়েছিল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিয়ে ড· কামালের নেতৃত্বে গণফোরামই বুঝি পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীন দল হতে যাচ্ছে। গণফোরামে যোগদানকারী সিপিবি সভাপতি সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক তার অনুসারী-সমর্থকদের প্রকাশ্যেই বলতেন যে, ‘আর বি-টিমের রাজনীতি নয়, এখন এ-টিমেই খেলবো।’ অর্থাৎ তাকে হয়তো সে রকম নিশ্চয়তাই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের আশা পূরণ হয়নি। গণফোরাম দেশের রাজনীতির এ-টিম হতে পারেনি। সে জন্যই কি আওয়ামী লীগকে বিব্রত করা ও অস্বস্তির অবস্থায় ফেলার লক্ষ্য নিয়ে ড· কামাল হোসেন কাজ করছেন? এক-এগারোর পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ড· ইউনূসও কিছু সময় নতুন দল গঠন করে ক্ষমতার রাজনীতিতে অংশীদার হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ ছাড়ার পর থেকে ড· কামাল হোসেন যে ভূমিকা পালন করেছেন তাতে আওয়ামী লীগবিরোধীরাই লাভবান হয়েছে, উৎসাহিত হয়েছে। তবে ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার যে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল সেখানেও ড· ইউনূস ও ড· কামাল হোসেন উদ্যোগী ভূমিকায় মাঠে নেমেছিলেন। তখন দলে সংস্ড়্গারের প্রস্তাব উত্থাপন করে আওয়ামী লীগের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাও শেখ হাসিনার বিরাগভাজন হন। পরবর্তীসময়ে তারা শেখ হাসিনার আনুগত্য মেনে নিলেও তার মন পাননি। তারা এখনও দলের মধ্যে অনাহুত। শেখ হাসিনা যদি দলের পরীক্ষিত নেতাদের ক্ষণিকের বিভ্রান্তি ও ভুলবোঝাবুঝির সীমা অতিক্রম করে সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন, তাহলে হয়তো তাকে সর্বগ্রাসী অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতার বিরুদ্ধে একাই লড়াই করতে হতো না।
উদ্যোগী হতে হবে আওয়ামী লীগকেই
১৯৭০-এর নির্বাচনের পর ২০০৮-এ আওয়ামী লীগ আবার গণমানুষের যুগান্তকারী সমর্থন পেয়েছে। ২০০৮-এর বিজয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তির অনুকূলে যাওয়ায় একটি সুস্থ রাজনীতির পথে ফেরার সম্্ভাবনা জাগিয়েছিল। সে রকম একটি সদিচ্ছায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিরীক্ষাধর্মী মন্ত্রিসভা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকজনের মৃতুøদণ্ড কার্যকর হয়েছে। বিদেশে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের তথা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষা, কৃষি, বিদ্যুৎ, খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত খাতগুলোতে লক্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের আশ্রয়ে জঙ্গিবাদের যে থাবা বিক্ষত করেছিল বাংলাদেশকে, বিগত তিন বছরে তার মূলোৎপাটন অনেকটাই করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু সরকার পরিচালনায় লক্ষণীয় গতি সৃষ্টি করে গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি সরকারের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করলেও তাদের এই দুবৃêত্তপনা থামানোর ব্যাপারে কোনো সক্রিয় উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সরকার পরিচালনা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক ধরনের অদূরদর্শিতা লক্ষ করা যায়। মন্ত্রিসভার অদক্ষতার কারণে সরকারের অর্জনগুলো মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়নি। এই বাস্তবতার মূল্যায়ন যথাসময়ে না করায় ঘুরে দাঁড়ানোর যে সুযোগ ছিল তা অবহেলায় নষ্ট করা হয়েছে। তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর পড়ন্ত বিকেলে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় সামান্য রদবদল ও সংযোজন ঘটিয়েছেন। যদিও এটা প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। প্রয়োজন যখন শল্য চিকিৎসার তখন সামান্য যোগ-বিয়োগ করে আরোগ্য লাভ করা যাবে না বলেই অনেকে মনে করছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের অনেকে সুপার মিনিস্টার বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। ‘অফারংবৎং ংযড়ঁষফ হবরঃযবৎ নব ংববহ হড়ৎ যবধৎফ, বীপবঢ়ঃ নুঃযব ড়হব যিড়সঃযবু ংযড়ঁষফ নব ধফারংরহম·’ এই আপ্তবাক্য উপদেষ্টাদের মেনে চলা উচিত।
এটা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, বর্তমানে দেশের মানুষ এক দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। হামলা-নাশকতা, হত্যা-খুন, বিডিআর ও সেনা সদস্যদের দিয়ে বিদ্রোহ ঘটানো সব ধরনের অপতৎপরতার সঙ্গেই প্রধান বিরোধী দলের জড়িত থাকার কথা শোনা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি, সংগঠনকে একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে এবং নিজ দলে সুস্থ রাজনীতি চর্চা বাড়াতে না পারে তবে প্রবল ও শক্তিশালী ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়বে। মানুষ চায় না আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল রাজনীতির পরাজয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুনরুত্থান ঘটুক। এবার যদি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় থাকতেও মুক্তিযুদ্ধের ধারায় রাজনীতির পরাজয় হয়, তাহলে দেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল ধারা প্রবল হয়ে উঠবে। গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল ও উদারনৈতিক চিন্তার অধিকারী মানুষের বাস-অযোগ্য হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। আওয়ামী লীগের কিছু ত্রুটি-দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতা আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ধারার পক্ষে তাদের অবস্থান এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারকে অস্বীকার করা যাবে না। আওয়ামী লীগ আর যাই করুক, হত্যা-কুø-জঙ্গিবাদী-হঠকারী রাজনীতি করে না। আর পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা যেখানেই আশ্রয় পাক অন্তত আওয়ামী লীগে তাদের ঠাঁই হবে না। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে প্রগতিশীল ধারার অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্্ভব বলে মনে হয় না। জঙ্গিবাদী-সুবিধাবাদী রাজাকারি চেতনাকে কবর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে আওয়ামী লীগকে এড়িয়ে নয়, আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়, তাদের সঙ্গে নিয়েই চূড়ান্ত লড়াইটা করতে হবে। এজন্য কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে একাট্টা হয়ে কাজ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব দল, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়কে। আর আওয়ামী লীগের বিপদ ও বিপর্যয়ে হাত গুটিয়ে বসে থেকে নীরবে দেখে গেলে চরম মূল্য দিতে হবে সবাইকেই।
মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্ব হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক ধারা বনাম পাকিস্তানি তথা মৌলবাদী-ধর্মান্ধ-জঙ্গিবাদী ধারা। প্রথম ধারাকে শক্তিশালী ও সংহত না করলে দেশ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। দেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। কাজেই সবাইকে নিয়ে চলার উদ্যোগটিও নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। জেনে বা না জেনে যারা ‘তৃতীয় শক্তি’, ‘বিকল্প শক্তি’ খোঁজার নামে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হওয়া উচিত দেশের রাজনৈতিক শক্তির বর্তমান মেরুকরণ দেখেই। সমালোচনা-আত্মসমালোচনা অবশ্যই থাকবে এবং চলবে কিন্তু সেটা যেন কোনোভাবেই পাকিস্তানি ধারার রাজনীতির যারা ধারক-বাহক তাদের উৎসাহ জোগানোর নামান্তর না হয়। একাত্তরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, সেই বিজয় কেড়ে নিতে দেওয়া যাবে না কাউকে, কোনোভাবেই। আমাদেরকে আবার একাত্তরের মতো দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে জয় বাংলা বলে।
১০ মার্চ ২০১২
অৎঃরপষব ভড়ৎ ইধহমষধফবংয ঋড়ঁহফধঃরড়হ-২
No comments:
Post a Comment