এনজিও লর্ডরা তদন্তের বাইরে থাকবেন?
মোনায়েম সরকার
কয়েকদিন আগে একটি
প্রথম শ্রেণীর
ইংরেজি জাতীয়
দৈনিকে প্রধান
প্রতিবেদন পরিবেশিত হয়েছিল জাতীয় পর্যায়ে
কর্মরত বেসরকারি
একটি সংগঠনকে
নিয়ে। এইচআইভি/এইডস বিষয়ক
কাজ করতে
গিয়ে এই
এনজিওটি গ্লোবাল
ফান্ডের কয়েক
কোটি টাকা
মেরে দেয়ার
তথ্য-প্রমাণ
উপস্থাপন করা
হয় ওই
প্রতিবেদনে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন- যেগুলো
আমাদের কাছে
এনজিও হিসেবে
বেশি পরিচিত- তাদের
দুর্নীতি-অনিয়মের
খবর প্রায়ই
চোখে পড়ে।
দেশের বিভিন্ন
স্থানে জনগণের
অর্থ নিয়ে
এনজিও কর্মকর্তাদের
উধাও হওয়ার
ঘটনাও এখন
বলতে গেলে
নিয়মিত বিষয়ে
পরিণত হয়েছে।
এগুলো হলো
প্রকাশিত কিংবা
প্রচারিত ঘটনা।
কিন্তু আরো
অনেক ঘটনা
নিশ্চয়ই আছে
যা প্রকাশ
হয় না
কিংবা প্রকাশ
করতে দেয়া
হয় না।
বড় বড়
এনজিওদের কাণ্ডকারখানা
তো পর্দার
অন্তরালেই চেপে রাখা হয়। বিভিন্ন
মহলকে ম্যানেজ
করে দরিদ্রদের
নাম করে
অথবা উন্নয়নের
কথা বলে
বিদেশ থেকে
আনা অর্থ
পকেটস্থ করার
মতো ন্যাক্কারজনক
ঘটনা ভুক্তভোগী
ছাড়া অন্য
অনেকের কাছে
অজানাই থেকে
যায়।
সরকারি কর্মকাণ্ডের ব্যাপক
সমালোচনা তথা ধীরগতি, লাল ফিতার
দৌরাত্ম্য ইত্যাদি প্রচারণা চালিয়ে এমন
একটা ধারণা
তৈরি করা
হয়েছিল যে,
এনজিও সেক্টরটি
একেবারে ধোয়া
তুলসীপাতা। মুখে সুশাসন, গায়ে গণতন্ত্রের
নামাবলী, পরনে
জনঅধিকার আর
জনসেবার লেবাস
কিন্তু বাস্তবে
এনজিওদের থলে
থেকে কি-সব বেরিয়ে
আসছে?
এটা ঠিক যে,
জনসেবার নাম
করেই এনজিওগুলো
সরকারের কাছ
থেকে নিবন্ধন
নিয়ে কাজ
শুরু করে।
তারপর বিভিন্ন
উন্নয়ন প্রকল্পের
অধীনে বিদেশি
দাতা সংস্থা
এবং সরকারের
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়
ও বিভাগ
থেকে সহায়তা
নিয়ে শিক্ষা,
স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, সুশাসন, নারী উন্নয়ন,
শিশু উন্নয়ন,
পানি সরবরাহসহ
বিভিন্ন সেবা
ও অধিকার
ভিত্তিক কাজ
শুরু করে।
তার সাথে
যুক্ত হয়
দারিদ্র্য বিমোচন হ্রাস করার লক্ষ্যে
ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম। কয়েক বছর আগে
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ কয়েকটি এনজিও’র ওপর
জরিপ চালিয়ে
একটি গবেষণা
প্রতিবেদন উপস্থিত করেছিল গণমাধ্যমের সামনে।
তাতে দেখা
গেছে যে,
এনজিওগুলোর নিজেদেরই কোনো সুশাসনের মানদণ্ড
নেই, জবাবদিহিতা
তো নেই-ই। তদুপুরি
দুর্নীতি, অনিয়ম ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়েছিল
পদে পদে।
শুধু জরিপকৃত ওইসব
এনজিও নয়,
দেশে কর্মরত
সব ছোট-বড় এনজিও
সম্পর্কেই সম্্ভবত টিআইবি’র
জরিপটিকে বিবেচনা
করা যেতে
পারে। সাম্প্রতিক
সময়ে নোবেল
জয়ী এক
এনজিও কর্তাকে
নিয়ে ব্যাপক
আলোড়ন চলছে
দেশে। প্রচলিত
আইন অনুযায়ী
যে-কোনো
নাগরিকের সম্পদের
হিসাব কিংবা
যে কোনো
প্রতিষ্ঠানের খোঁজখবর নেয়ার অধিকার রাষ্ট্রের
হাতে আছে।
সেই সূত্রে
বিশেষ কোনো
ব্যক্তি বা
প্রতিষ্ঠান নিয়ে সরকারি সংস্থা তৎপর হলে
হায় হায়
রব উঠবে
কেন? বাংলাদেশের
এই অভ্যন্তরীণ
বিষয়টি নিয়ে
বিদেশ বিশেষত
বিশ্বের সবচেয়ে
শক্তিধর রাষ্ট্র
বলে পরিচিত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও
জড়িত হয়ে
পড়েছে। একটি
স্বাধীন-সার্বভৌম
দেশের অভ্যন্তরীণ
বিষয়ে বিদেশি
রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিদের নাক গলানো
নিয়ে প্রতিবাদ
দূরে থাক
আমাদের সুশীল
সমাজ আর
বিরোধী দল
উল্টো সমর্থন
জুগিয়ে সরকারের
মুণ্ডপাত করতেই
উৎসাহী
হয়ে উঠেছেন।
অথচ তারা
একবারও কি
ভেবেছেন যে,
আইন অমান্য
করে সেই
নোবেল বিজয়ী
কীভাবে নির্ধারিত
বয়স পার
হওয়ার পরও
একটি প্রতিষ্ঠানের
প্রধান নির্বাহী
থাকেন? বলা
হচ্ছে যে,
তিনি না
থাকলে প্রতিষ্ঠান
ধ্বংস হয়ে
যাবে? তাহলে
প্রশ্ন আসে,
তিনি কি
নোবেল জয়
করে মৃতুøকেও জয়
করে ফেলেছেন?
তার অবর্তমানে
ওই প্রতিষ্ঠান
ধ্বংস হয়ে
গেলে কেমন
সংগঠন তিনি
গড়ে তুললেন,
কেমন সুশাসন
প্রতিষ্ঠা করা হলো যে, তার
অবর্তমানে সব শেষ হয়ে যাবে?
আসলে এনজিওগুলোর কাঠামোই
এ রকম।
যিনি প্রতিষ্ঠা
করেন তিনি
ডালপালা জড়িয়ে
সেই এনজিও’র কাণ্ডারি
হয়ে থাকেন
আমৃতুø।
এখানে কোনো
বয়সের বালাই
নেই, অবসরের
ব্যাপার নেই,
একেবারে রাজতন্ত্র
বা সামন্ততন্ত্রের
ধারা। গাড়ি,
বাড়ি, অর্থ,
বিদেশ সফরসহ
এক মহা
সুখের নহরে
অবগাহন করে
চলেছেন এনজিও
লর্ড, নাইট
আর স্যারগণ।
কেউ কেউ
হয়তো সত্তরোর্ধ
হয়ে প্রধান
নির্বাহী পদে
একজন ক্রীড়নক
বসান যাতে
প্রকৃত ক্ষমতা
তার হাতেই
থাকে। অর্থবিত্ত
সব থাকে
তারই নিয়ন্ত্রণে।
অথচ এরাই
রাজনীতিকদের কথায় কথায় সবক দেন
সুশাসনের। এরাই প্রশ্ন তোলেন বেশি
যে, রাজনৈতিক
দলের শীর্ষ
নেতৃত্ব কেন
যুগ যুগ
ধরে একই
থাকে, রাজনৈতিক
দলের অভ্যন্তরে
কেন গণতন্ত্রের
চর্চা হয়
না-
ইত্যাদি। নিজেদের সংগঠনের ব্যাপারে তারা
টঁু শব্দটি
করেন না।
এনজিওগুলোর একটি সাধারণ পরিষদ ও
নির্বাহী পরিষদ
থাকে বটে।
বাস্তবে এগুলো
রাবার স্ট্যাম্পের
মতো, অধিকাংশ
ক্ষেত্রে সব
সিদ্ধান্তই হয় প্রধান নির্বাহীর ইচ্ছানুযায়ী।
দরিদ্র মানুষের সেবা
করার নামে
উন্নয়ন প্রকল্প
বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার নিয়ে এনজিও
নেতারা মাঠে
থাকেন। বাস্তবে
কি হয়?
বিলাসবহুল গাড়ি, হাজার হাজার বর্গফুটের
ফ্ল্যাট, বিমানের
বিজনেস ক্লাসে
হরহামেশা বিদেশ
ভ্রমণ, লাখ
লাখ টাকা
মাসোহারা- এসব কি দরিদ্র
সেবার নমুনা?
যদি জনসেবাই
উদ্দেশ্য হবে
তবে মাদার
তেরেসার মতো
নীল পাড়
শাদা শাড়ির
বদলে হাজার
হাজার টাকার
পোশাক কেন
অঙ্গের ভূষণ
হয় তাদের?
তাদের সন্তান
আর পরিবারের
সদস্যরা কীভাবে
বিদেশে উচ্চ
শিক্ষার জন্য
লাখ লাখ
ডলার খরচ
করেন? সাহায্য
তহবিলের টাকা
কীভাবে নয়ছয়
করে নিজের
একাউন্টে ঢুকিয়ে
দেন?
অস্বীকার করার উপায়
নেই যে,
এনজিওদের মাধ্যমে
দেশে কর্মসংস্থানের
সুযোগ সৃষ্টি
হয়েছে, অনেক
শিক্ষিত তরুণ-তরুণী বেকারত্বের
জ্বালা দূর
করতে সক্ষম
হয়েছে। কিন্তু
যে-পরিমাণ
টাকা এনজিও
খাতে ব্যয়
হচ্ছে, সে
অনুপাতে প্রকৃত
উন্নয়ন কতটুকু
হচ্ছে, সেটা
অবশ্যই একটি
বড় অনুসন্ধানের
বিষয়। ক্ষুদ্রঋণ
ব্যবস্থা দারিদ্র্য
মোচনে কতটুকু
ভূমিকা রাখছে,
নারীর ক্ষমতায়নে
সত্যিকার অর্থে
এনজিওর অবদান
কতটুকু-
এসব নিয়ে আমাদের দেশে সিরিয়াস
গবেষণা হওয়া
দরকার। এনজিওদের
ভাবসাব দেখে
মনে হয়,
তারা হচ্ছে
প্যারালাল সরকার বা বিকল্প সরকার।
কিন্তু এই
বিকল্প সরকার
প্রকৃত সরকারের
চেয়ে যদি
ভালো সার্ভিস
না দিয়ে
কেবল কতিপয়
মানুষের ব্যাংক
ব্যালান্স বাড়ানোর উপায় হয়ে থাকে,
তাহলে এর
লাগাম টেনে
না ধরে
উপায় কী?
এনজিও নেতারা সভা-সেমিনারে জনঅংশগ্রহণের
কথা বলে
আনন্দ পান।
কিন্তু তাদের
নিজেদের প্রতিষ্ঠানের
সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় জনগণ দূরে
থাকুক নিজ
সংগঠনের কয়জনকে
সম্পৃক্ত করা
হয় বাস্তবে?
জনবিচ্ছিন্ন একটি কর্পোরেট কালচার গড়ে
তোলা হয়েছে
এনজিও মহলে,
যেখানে প্রধান
নাটের গুরু
হয়ে দেখা
দেন এনজিও
লর্ড বা
লেডী। তাদের
চলনে বলনে,
ঠাটে বাটে
কি দরিদ্র
সেবার কোনো
লক্ষণ ফুঠে
ওঠে? তাদের
সম্পদ করমুক্ত,
তাদের অর্থ
জবাবদিহিতার উর্ধ্বে, তাদের ব্যাংক হিসাব
অডিটের বাইরে- এমন অভিযোগ প্রায়ই
শোনা যায়।
এ-সব
কি স্বচ্ছ
ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক?
জনসেবার শপথ নিয়ে
কাজ শুরু
করে ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, লিজিং
কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, এপোর্ট-ইমপোর্ট ইত্যাদি
অনেক কিছুই
করছে এনজিওগুলো।
অলাভজনক প্রতিষ্ঠান
হিসেবে নিবন্ধিত
হয়ে লাভজনক
ব্যবসা এখন
অনেক এনজিওর
মূল কাজে
পরিণত হয়েছে।
ওই সব
প্রতিষ্ঠানের আয়ে কি দরিদ্র মানুষের
কোনো ধরনের
প্রবেশাধিকার আছে? এনজিও বিশ্ববিদ্যালয় কি
গরিবের জন্য
অবারিত? এনজিও
চালিত অন্যান্য
ব্যবসা কি
দরিদ্রবান্ধব? সামাজিক ব্যবসা বলে যে
বড় বুলি
আওরানো হয়- তা সমাজের কোন
অংশের জন্য?
মুখে রাজনীতিকদের
গাল দিয়ে,
বাস্তবে বিদেশি
প্রভুদের পদসেবা
করে বিদেশি
বিভিন্ন পদক-পুরস্ড়্গার ইত্যাদি
বুকে ঝুলিয়ে
আর যাই
হোক জনসেবা
যে হয়
না সেটা
বোধহয় খুব
বেশি ব্যাখ্যা
করার প্রয়োজন
হয় না।
লুটপাটের রাজত্ব
কায়েম করে
সুশাসন আর
দুর্নীতিবিরোধী কথা বলা কি এনজিও
বসদের মুখে
খুব মানায়?
এনজিওগুলোর প্রধানরা এক
ধরনের ভালো
মানুষী লেবেল
এঁটে কার্যত
দেশের ভেতর
সাম্রাজ্যবাদ কিংবা বিদেশি পুঁজির আজ্ঞাবহ
হয়ে কাজ
করছে, সেটা
ক্রমশই স্পষ্ট
হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক শক্তির
ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা এক সময় তাদের স্বার্থের
পাহারাদার হিসেবে সামরিক বাহিনীর ওপর
ভর করতো।
ওই কৌশলটি
বহু নিন্দিত
হওয়ায় তারা
এখন এনজিওর
ওপর নির্ভর
করে আমাদের
মতো দেশগুলোতে
অনুগত সরকার
প্রতিষ্ঠার কলকাঠি নাড়ছে বলে মনে
করাটা যে
খুব অনুচিত
নয়, সেটা
নানা ঘটনা
থেকেই বোঝা
যাচ্ছে। সে-জন্যই এখন
বোধহয় সময়
এসেছে, দু’একটি এনজিও
নয়, বড়
বড় সব
এনজিও লর্ডদের
ব্যাপারে খোঁজখবর
নেওয়া, তাদের
সম্পদের হিসাব
নেওয়া। কেউ
যেন আইনের
উর্ধ্বে না
থাকেন, কেউ
যেন জবাবদিহিতার
বাইরে না
থাকেন।
১১ আগস্ট ২০১২